কালীমূর্তিতে শক্তি আরাধনা ঠিক কত বছর ধরে হয়ে আসছে? এর সময়কাল নিয়ে বিতর্ক চিরকাল। তবে সিংহভাগের মধ্যেই প্রচলিত, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বঙ্গদেশে প্রথম আজকের পরিচিত কালীমূর্তির অবতারনা করেন। আগমবাগিশের এই শক্তি সাধনার স্থানটি হলো নদিয়ার নবদ্বীপ, মতান্তরে শান্তিপুর। মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ বাগীশ ভট্টাচার্য বা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। শোনা যায়, তিনি চৈতন্যের সহপাঠী ছিলেন। রঘুনন্দন শিরোমণি, রঘুনন্দন ভট্টাচার্য ও চৈতন্য একই টোলে শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন নবদ্বীপে।
পরবর্তীকালে চৈতন্য সখীভাবে কৃষ্ণভজনের পথে গেলেন, এবং কৃষ্ণানন্দ শাক্ত পথ অবলম্বন করেন। আবার ভিন্নমতও রয়েছে, বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায়, চৈতন্যের মৃত্যুর অন্তত ৭০ বছর পরে জন্ম কৃষ্ণানন্দের। আনুমানিক ১৬০৫-১৬১০ সালে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এবার আসি কিভাবে বর্তমান কালীমূর্তি রূপ পেল আগমবাগীশের কল্পনায়। কদিন ধরে বড় চঞ্চল হয়ে ছিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশ। কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না তাঁর ইষ্টদেবীর রূপকল্পটি। করালবদনী শক্তিরূপা দেবী কালিকার শান্ত কোমল এক রূপের খোঁজে তিনি আকুল হয়ে ছিলেন। কারণ তিনি বুঝেছিলেন, কালীর ভয়াল রূপকে গৃহস্থের ঘরে স্থাপন করতে গেলে দরকার এক কল্যাণময় রূপের। শক্তির উপাসনাকে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চান তিনি। কিন্তু কী হবে দেবী কালিকার শান্ত কোমল রূপ?
কথিত আছে এই রকম একটা সময় হঠাৎ দৈববানী শোনের কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝেই কৃষ্ণানন্দ শোনেন কে যেন বলছে, ‘ভক্তের মধ্যেই থাকেন ভগবান। মিথ্যেই তাঁকে অন্যত্র খুঁজছ। একবার মাটির দিকে তাকাও প্রত্যয়ের দৃষ্টিতে। ভোরের প্রথম আলোয় খুঁজে পাবে তোমার আরাধ্যার দেবীরূপ। সেই নতুন রূপেই প্রতিষ্ঠা পাবেন দেবী কালিকা’। সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি দেখেন কেউ নেই আশেপাশে। এরপর তাঁর মনে আর সংশয় থাকল না।
পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গোয়ালা পল্লী দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন গঙ্গার ঘাটের দিকে। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ে এক গোপবধূকে। গায়ের রঙ কালো, কিন্তু কী অপরূপ লাবণ্য তাঁর। কর্মব্যস্ত বধূকে দেখে থমকে গেলেন কৃষ্ণানন্দ। একঢাল ঘন কালো চুল কোমর ছাপিয়ে প্রায় হাঁটু ছুঁই ছুঁই। পরনে খাটো বস্ত্র। ডান পা সামনের পাঁচিলে বাড়িয়ে বাঁ হাতে একতাল গোবর নিয়ে ডান হাতে করে কুটিরের মাটির দেওয়ালে ছুঁড়ে ছুঁড়ে প্রলেপ দিচ্ছে সেই কৃষ্ণবর্ণ বধূ। সারা মুখ পরিশ্রমের ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু। তাতে কপালের সিঁদুর ধেবড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে দুই ভ্রু জুড়ে। তাঁর চোখে এক অপরূপ মায়া ছড়িয়ে রয়েছে। ওই গোপবধূকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ।
ক্ষানিক পরই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রবল প্রতাপশালী মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণানন্দ বাগীশ ভট্টাচার্যকে দেখে বিব্রত বধূ নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করলেন। আর তাতেই তাঁর পরনের স্বল্পবাসটুকুও গেল খসে। কিন্তু দুহাতেই গোবর থাকায় মুখ ঢাকতে না পেরে লজ্জায় জিভ কাটলেন ওই নিরুপায় বধূ। শেষ রাতে শোনা দৈববানীর কথাগুলো ফের বাজতে থাকল কৃষ্ণানন্দের কানে। এটিই তাঁর আরাধ্য দেবীর মৃন্ময় মূর্তি, বুঝতে অসুবিধা হলনা আগমবাগীশের। মহাপণ্ডিত আগমবাগীশের মনে পড়তে লাগল ‘কালীতন্ত্রে’ দেবীর রূপের বর্ণনা—‘করালবদনা ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম/ কালিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুন্ডমালা বিভূষীতাম/ সদ্যশ্ছিন্নশিরঃ খড়গ বামাবোর্ধ করামবুজাম/ অভয়ং বরদাঞ্চৈব দক্ষিণাদ্ধোর্ধ পানিকাম’। ব্যাস তিনি আর সময় নষ্ট না করে তৎপর হলেন কল্পনার দেবীমূর্তিকে রূপদান করতে।
দেবী ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, আলুলায়িত কেশরাশি। গোবরের তাল ধরা ডান হাতে যেন বরাভয়ের মুদ্রা। বাঁ হাতে খড়্গ। জীবজগতের মঙ্গল এবং আসুরিক শক্তির বিনাশের জন্য যা সদা উদ্যত। দেবীর দু’চোখে অপার করুণা। কপালে জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিঁদুর যেন দেবীর তৃতীয় নয়ন। পণ্ডিত আগমবাগিশ ছিলেন কালীউপাসক। বাঙলায় শক্তি আরাধনা আগেও হয়েছে কিন্তু কালীমূর্তির অবতারণা করে শক্তির আরাধনা সম্ভবত তাঁর হাতেই। আগমবাগীশের কালী আরাধনার রীতি মেনে আজও নবদ্বীপ শহরে কালীপুজোর সকালেই মায়ের মূর্তি নির্মাণ করা হয় এবং পুজো শেষে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই প্রতিমা নিরঞ্জন দেওয়া হয়।
إرسال تعليق
Thank You for your important feedback