রাজস্থানের কুম্ভলগড় দুর্গ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর

চিনের পাঁচিলের নাম তো সকলেই শুনেছেন। সকলেই জানেন, এটিই বিশ্বের দীর্ঘতম পাঁচিল। কিন্তু জানেন কি বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম পাঁচিল কোথায় আছে? শুনলে আশ্চর্য হবে সেটি আছে আমাদের এই দেশেই। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হল চিনের প্রাচীর। যার দৈর্ঘ্য ৬,৪০০ কিলোমিটার। এটি এতটাই বড় যে মহাকাশ থেকেও দিব্যি দেখা যায়। আর এর পরেই পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীরটি রয়েছে রাজস্থানের কুম্ভলগড়ে। উদয়পুর থেকে ৮২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, মেবার ও মারোয়াড়ের সীমান্তে একটি দুর্গ তৈরি করিয়েছিলেন মহারাণা কুম্ভ। তাঁর নামেই এর নাম রেখেছিলেন কুম্ভলগড়। আর রাজস্থানের কুম্বলগড় দুর্গকে ঘিরে রয়েছে একটি সুবিশাল প্রাচীর। যা ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রাচীরটির আড়াআড়ি বিস্তারও তাক লাগানোর মতো। এই পাঁচিলের ওপরে ৮টি ঘোড়া পাশাপাশি চলতে পারে। এটিই পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম পাঁচিল। বর্তমানে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সাইটের (UNESCO World Heritage Sites) অংশ।

কুম্ভলগড় দুর্গ, রাজস্থানের আর পাঁচটা দুর্গের মতোই আকর্ষক। এর ইতিহাসও বেশ উজ্জ্বল ও চিত্তাকর্ষক। যদিও চিতোরগড় বা জয়সলমেরের সোনার কেল্লার মতো খ্যাতি কুম্ভলগড়ের নেই। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ, ইতিহাস আর স্থাপত্য মিলেমিশে এখানকার আকর্ষণ কোনও অংশেই কম নয়। রীতিমতো সাতটি দরজা পেরিয়ে ঢোকা যায় কুম্ভলগড় প্রাসাদে। এই দরজাগুলিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘পোল’। যেগুলি কারুকাজ করা পাথরের খিলানের মধ্যে কাঠের তৈরি। প্রথম ‘পোল’ সর্ব দক্ষিণে, নাম অ্যারেত পোল। এটা পার করলেই দর্শন মেলে কুম্ভলগড় দুর্গের। কালচে-হলুদ বেলে পাথরের দুর্গটি রহস্য-রোমাঞ্চে ভরপুর। প্রায় ১৫ বছরের প্রচেষ্টায় দূর্গটি নির্মাC করেন মহারাণা কুম্ভ। আর দূর্গের সুরক্ষায় তিনি নির্মাণ করান ৩৬ কিলোমিটার প্রাচীরের। এর পিছনেও আছে রোমাঞ্চকর গল্প। কথিত আছে, এই প্রাচীরটির জন্য দুর্গটি ছিল কার্যত অজেয়। তাই একসময় এর নাম হয়ে যায় ‘অজেয়গড়’। মুঘলরাজ আকবর অনেকবার চেষ্টা করেছিলেন এই দুর্গের দখল নিতে, তিনি বেশ কয়েকবার ওই প্রাচীরের গায়ে গর্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। 

 কুম্ভলগড় দুর্গের ভিতরে রয়েছে ৩০০টির বেশি মন্দির। মোট ৩৬০টি মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই জৈন মন্দির। বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরও রয়েছে। আর অবাক করা তথ্য হল, এই দুর্গের ভিতরই রয়েছে আরেকটি দুর্গ যার নাম ‘কাতারগড়’। আগেই বলেছি, এই দুর্গে প্রবেশের জন্য সাতটি প্রবেশপথ বা পোল রয়েছে। যার নামগুলি হল অ্যারেতপোল, হাল্লাপোল, হনুমানপোল, ভৈরব পোল, পাগড়া পোল এবং বিজয়পোল প্রমুখ। দুর্গটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১,১০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে কোথাও হালকা কোথাও গাঢ় সবুজের আরাবল্লী পাহাড়ের মাথায় এই দুর্গটি পর্যটকদের কাছে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়। 

৩৬০টি মন্দির, বেশ কিছু ঘরবাড়ি, পাথরে বাঁধানো উঁচু-নিচু রাস্তা, প্রাসাদ, মহল নিয়ে আরাবল্লীর কোলে ছড়িয়ে রয়েছে এই কুম্ভলগড় দুর্গ। এর ভিতরে মন্দির ও মহলে পাথরের কারুকার্য দেখার মতো। বিশাল গম্বুজ ও ছাদ, স্তম্ভ এবং খিলানগুলি দেখার মতো। এখানে প্রাচীন নীলকন্ঠ মন্দিরে রয়েছে ৬ ফুটের শিবলিঙ্গ, রামপোলের বাঁ দিকে রয়েছে প্রাচীন গণেশ মন্দির। যেখানে রাণা কুম্ভ নিয়মিত পুজো করতেন। আরও এই মন্দির দুটিতে নিত্যপুজো হয়। 

ইতিহাস বলে ১৫৪০ সালে মহারাণা প্রতাপ এখানকার এক প্রাসাদেই জন্ম নিয়েছিলেন। কুম্ভলগড়ের রাজপ্রাসাদের বাদলমহলটি দেখার মতো। এখানে মেঘেদের নিত্য আনাগোনা চলে। রাণা ফতেহ সিং রাজপুত স্থাপত্যশৈলীতে এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। জাঁকজমক নয়, প্রতিরোধ ও অনমনীয়তাই ছিল কুম্ভলগড়ের আসল গর্ব। আর সেই গরিমা এবং ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রানা কুম্ভের কুম্ভলগড় দুর্গ। আর তাঁকে ঘিরে রেখেছে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচিরটি।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

أحدث أقدم