মিরাটি থেকে রাইসিন হিলস, এক বিস্ময়ের যাত্রা

আশিস ঘোষ

পাঁচদশক ধরে রাজনীতি করেছেন তিনি। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে তাঁর কথা মনে পড়লেই। কত উত্থানপতন, কত হাততালি আর অবহেলার সাক্ষী হতে হয়েছে একজন সাংবাদিককে। তার অনেকটাই লেখা যায়নি, বলা যায়নি। যাকে বলে অফ দ্য রেকর্ড। তবে যে কেউ মানবেন, তাঁর কথা উঠলে গোড়াতেই মনে আসবে তাঁর অসম্ভব স্মরণশক্তির কথা। যে কোনও প্রসঙ্গে সন তারিখ ধরে ধরে তাঁর অনায়াস বলে চলা চমকে দিত আমাদেরও। ফলে যেটুকু সময় তাঁর সঙ্গে আড্ডা মারার মতো ছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই এক একটা ক্লাস। কখনও জরুরি অবস্থার সময়কার ইন্দিরা, কখনও বাংলা কংগ্রেস থেকে যুক্তফ্রন্ট মুগ্ধ হয়ে শুনে যাওয়া কত অকথিত কাহিনি।

আর ছিল স্মিত হাসি। হয়তো কখনও কখনও মেজাজ হারাতেন শেষদিকে। তবে কখনও কাউকে কুকথা বলা, গালমন্দ করতে শুনিনি তাঁর মুখে। আড্ডা বেশি হত যখন প্রণববাবু যখন কংগ্রেস ছেড়ে তাঁর প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস গড়ার পর। কলেজ স্কোয়ার লাগোয়া গলিতে ছোট অফিসে চা, মুড়ি, তেলেভাজার সঙ্গে অতীত চারণ। সে এক অন্য প্রণব মুখোপাধ্যায়, যিনি ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রিসভার দুই নম্বর নন, দিল্লির গম্ভীর পাইপমুখে অর্থ, প্রতিরক্ষা, বিদেশের মতো ভারী ভারী মন্ত্রকের মন্ত্রী নন। নিছকই প্রণবদা। কথায় কথায় উঠে আসত মিরিটির কথা। তাঁর পরিবারের কথা। কী কঠিন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি, কলেজের অধ্যাপনার কথা, প্রথমবার দিল্লিতে গিয়ে কেমন হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন বেশ মজা করে বলতেন তিনি। সে একেবারে অন্য অন্য প্রণববাবু।

ঘটনাচক্রে প্রণববাবুর জীবনের একটা বড় বাঁকের সময় আমি ছিলাম তাঁর সঙ্গে। রাজীব গান্ধি তখন রাজ্য সফরে। সঙ্গী যেমন প্রণববাবু, বরকত গনি খান চৌধুরী, তেমনই প্রদেশ কংগ্রেসের ছোটবড় অনেক নেতা। এবং অবশ্যই কলকাতা থেকে একদল সাংবাদিক। ১৯৮৪ সাল। সফরের শেষদিনে কলকাতা ফিরছিলেন রাজীব। মাঝপথেই থেমে গেল কনভয়। আমরা খবর পেলাম নিজের বাড়িতে হত্যা করা হয়েছে ইন্দিরাকে। কোলাঘাট থেকেই হেলিকপ্টারে রাজীব, প্রণববাবু, গনিখান চৌধুরীরা উড়ে গেলেন কলকাতা হয়ে দিল্লি। ইন্দিরার পরে কে, তা নিয়ে তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল নানা জল্পনা। প্রধানমন্ত্রী পদে প্রণববাবু নিজে আগ্রহপ্রকাশ করেছিলেন, এমন জল্পনায় তখন রাজধানী সরগরম। গোটা জল্পনাটাই হয়েছিল কলকাতা থেকে দিল্লি ফেরার বিমানে, এমনটাই ছিল রটনা। তারপর থেকেই রাজীব গান্ধির কোপে পড়েন তিনি। একসময় দল থেকে বহিষ্কারও হন তিনি।

বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের স্নাতক পলিটিকাল সায়েন্স, ইতিহাস ও আইনে স্নাতকোত্তর প্রণববাবু যোগ দিয়েছিলেন ডাকবিভাগে। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৯ সালে নির্বাচনের সময় মেদিনীপুরে ভি কে কৃষ্ণমেননের ভোটের দায়িত্ব নিয়েই প্রথম ইন্দিরার নজরে আসেন তিনি। সেখান থেকে সেবছরই রাজ্যসভায়। তারপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হন।

প্রণববাবুকে বলা হত রুটলেস ওয়ান্ডার। শিকড়হীন বিস্ময়। চালু অর্থে জননেতা ছিলেন না কোনওদিনই। পরে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হলেও নিজের রাজ্যে তেমন কোনও প্রভাব ছিল না তাঁর। তবে দিল্লিতে তিনি পরিচিত ছিলেন ম্যান অফ অল সিজনস বলেই। ইউপিও এক ও দুইয়ের সময় তিনিই ছিলেন জোটসঙ্গীদের সঙ্গে সবরকম বোঝাপড়ার দায়িত্বে। তবে সেসময় তাঁর কৃতিত্বের তালিকায় সবথেকে উপরে ইন্দিরার আমলে প্রথম আইএমএফ ঋণের সব কিস্তি ফেরত দেওয়া। 

কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনিই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন মনমোহন সিংকে। পরে তিনিই হন মনমোহনের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী। বারবার কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁর লক্ষ্য নয়। তবু প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়েই কার্যত তাঁর ভাগ্য বিড়ম্বনার শুরু। দল থেকে বিতাড়িত হয়ে প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস গড়েও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি রাজ্য রাজনীতিতে। তবে ১৯৭৮ সাল থেকেই তিনি ছিলেন এআইসিসি সদস্য, কংগ্রেস সংসদীয় দলনেতার মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ দলীয় পদে।

কপাল ফেরে রাজীব গান্ধির হত্যার পর। প্রথমে যোজনা কমিশন, তারপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যান তিনি। নরসীমা মন্ত্রিসভায় হন বিদেশমন্ত্রীও। আগাগোড়া গান্ধি পরিবারের অনুগত বলে পরিচিত প্রণববাবু ছিলেন দলের সভানেত্রীর পদে সোনিয়া গান্ধিকে নিয়ে আসার পিছনে। ২০০৪ সালে ইউপিএ-র প্রধানমন্ত্রী হতে যখন অস্বীকার করেছিলেন সোনিয়া, তখনও চর্চা হয়েছিল তাঁর নিয়ে। শেষপর্যন্ত সবাইকে অবাক করে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post