নির্জনতাকে সঙ্গী করে মনের মানুষকে নিয়ে ঘুরে আসুন আদিম আন্দামানে (প্রথম পর্ব)

আমি আদার ব্যাপারী, তাই জাহাজের খোঁজ না নিয়ে উড়োজাহাজেই চেপে বসলাম। উড়ে চলেছি কালাপানির উপর দিয়ে। না কালাপানি মানে কালো জল নয়, ইতিহাসের এক মর্মান্তিক ঘটনাবলীর সাক্ষী বঙ্গোপসাগর। স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্মান্তিক এক ইতিহাসে এর নাম কালাপানি। আমরা উড়ে চলেছি পোর্টব্লেয়ারের উদ্দেশ্যে। বিমানের সিটে বসে সেই সমস্ত গল্পগাথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভরতের বহু মহান বিপ্লবী যাঁদের ব্রিটিশ সরকার দিয়েছিল ‘সাজায়ে কালাপানি’। বঙ্গোপসাগরের বুকে ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। যার মাত্র ৩৮টিতেই মানুষের বাস। এই দ্বীপপুঞ্জের বড় দ্বীপ পোর্ট ব্লেয়ার, যেখানেই অবস্থিত সেলুলার জেল। যেখানে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের সাজা দিতে দ্বীপান্তরে পাঠাতো। চারিদিকে জলের মাঝে ছোট্ট এক টুকরে দ্বীপে এই জেল এক সময় ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচারের অন্যতম নিদর্শন। যদিও বর্তমানে এই জেল মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। এই সমস্ত সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যেই ঘোর কাটল বিমানের ক্যাপ্টেনের ঘোষণায়। বিমানের জানলায় চোখ যেতেই দেখলাম দীগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাথা তুলেছে কিছু স্থলভাগ। এগুলোই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসলাম বীর সাভারকার বিমানবন্দরে।

আদিম অরণ্য ও তার ভূমিপুত্রদের অবাধ বাস এই আদিম আন্দামান ও নিকোবরে। এখানকার দ্বীপভূমে রয়েছে অসংখ্যা আদিম জনজাতি। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে আবার সভ্যতার ছিটেফোঁটাও পৌঁছায়নি। ফলে সভ্য জগতের মানুষদের গতিবিধি সীমিত মাত্র কয়েকটি দ্বীপেই। আদিম অরণ্য ও সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আন্দামানে প্রকৃতি যেন অপরূপ ক্যানভাসে রাঙিয়ে দিয়েছে এখানকার দ্বীপগুলিকে। ফলে পর্যটনের স্বর্গরাজ্য আন্দামান। আর এখানকার নির্জন সৈকতগুলির নিসর্গ নবদম্পতির জন্য আদর্শ ‘হানিমুন ডেস্টিনেশন’। হ্যাভলক, নীল, মায়াবন্দরের মত দ্বীপে তাই নবদম্পতিদের দেখা মিলবে হামেশাই। তবে সাধারণ পর্যটকদের জন্যও রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। সমুদ্রের তলায় কোরালের অপরূপ দৃশ্য ও রঙ-বেরঙের মাছ ‘লাইভ’ দেখতে পারবেন খালি চোখেই। আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের জন্য রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ও স্কুবা ডাইভিংয়ের সুযোগ।


পোর্ট ব্লেয়ার-

বিমানবন্দর থেকে হোটেলে চেক-ইন করে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম শহর দেখতে। ঝকঝকে তকতকে ছোট্ট শহর পোর্ট ব্লেয়ার। সমুদ্রের ধার বরাবর সুন্দর সাজানো গোছানো। কাছেই রয়েছে রাজীব গান্ধি মেরিন পার্ক। সাগর পারে সুন্দর বাগান অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এই পার্কে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা যায় সমুদ্রে ভাসমান রঙ-বেরঙের পালতোলা নৌকা। দূরে দেখা যায় রস ও ভাইপার আইল্যান্ডের তীরভূমি। কিছুটা দূর দিয়ে জাহাজের আনাগোনা। আচমকাই মনে হল এই বুঝি বিদেশের কোনও শহরে চলে এসেছি। ভোরবেলা ও পড়ন্ত বিকেলে এই পার্কে ইতিউতি ঘুরতে বেশ লাগে। রাজীব গান্ধি মেরিন পার্কের আদূরেরই দেখলাম অ্যাকোরিয়াম। বিশাল বিশাল কাঁচের জলাধারে নাম না জানা অসংখ্য মাছ রয়েছে এই অ্যাকোরিয়ামে। দেখলাম বিভিন্ন প্রবাল ও কোরাল। মন ভরিয়ে ফিরলাম হোটেলে। দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম। সন্ধ্যের মুখে ফের চলে এলাম রাজীব গান্ধি মেরিন পার্কে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদে চিক চিক করছে সাগরের নোনা জল। হাওয়া খেতে খেতে দেখা যায় দূরের জাহাজের আনাগোনা। 

সন্ধ্যেবেলা একটু উপরের দিকে উঠে এলাম। পোর্ট ব্লেয়ারের এক কোনায় রয়েছে সেলুলার জেল। বিমূর্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ আমলের এক মর্মান্তিক নিদর্শন। এখন অবশ্য সেলুলার জেল একটি সংগ্রহশালা। টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে। এটা প্রতিদিনই সন্ধ্যে বেলা দেখানো হয়। ধ্বনি ও আলোর খেলায় সেলুলার জেলের করুণ ইতিহাস শুনে মনটা ভারাক্রান্ত হবেই। এই লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-তে শুনলাম নানান অজানা ইতিহাস। ভারতের বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের কাহিনী। তাই চোখের কোনে জল নিয়েই ফিরলাম হোটেলে। বলে রাখি পুরো সেলুলার জেল অর্থাৎ সংগ্রহশালাটি দেখতে অবশ্যই সকালে বা দুপুরে একবার আসতে হবে।


এরপর দ্বিতীয় পর্বে….

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post