পাখির স্বর্গরাজ্য কমলালেবুর গ্রাম সিটং-মংপু

আমরা প্রায় সকলেই কমলালেবু খেতে ভালোবাসী। শীতকালীন ফলগুলির মধ্যে অন্যতম এই কমলা দেখতেও চমৎকার। কিন্তু ভাবুন একবার, যদি দেখতে পান ঝাঁকে ঝাঁকে কমলা গাছে ঝুলে আছে, কোনও আধকাঁচা, কোনওটা আবার পাকা টসটসে। তাহলে কেমন হয়? এই রাজ্যেই আছে এমন একটি জায়গা, যেখানে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন এই স্বর্গীয় দৃশ্য। সেই সঙ্গে নির্জন এক পাহাড়ি গ্রামের অভিজ্ঞতা ফ্রি। তবে সেখানে যেতে হবে শীতকালেই। জানেন কি, দার্জিলিংয়ের কাছেই আছে সেই গ্রাম। 


দার্জিলিংয়ের খ্যাতি নানা বিষয়ে, যার মধ্যে একটি এই কমলালেবু। আর মজার কথা দার্জিলিং-এর বিখ্যাত কমলালেবুর সিংহভাগই উৎপন্ন হয় সিটংয়ে। তাই আমাদের গন্তব্য সিটং। এখানে যাওয়ার সেরা সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এই সময় সিটং-এর সমস্ত কমলালেবুর গাছই ফলে ভরে থাকে। তবে পাহাড়ের কোলে থাকা ছোট্ট গ্রাম সিটং কিন্তু প্রকৃতির রঙতুলিতে আঁকা নিখুঁত একটি পর্যটন কেন্দ্র। যারা দার্জিলিংয়ের ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে একটু নির্জনতার খোঁজ করেন তাঁদের জন্য সিটং আদর্শ হতে পারে। তবে কমলার টানে এখন একটু আধটু ভিড় হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সিটংয়ের কাছেই রয়েছে মংপু। দুটি জায়গায় কয়েকটা দিন আরামে কাটিয়ে আসা যায়।

সিটং—

লেপচাদের এই গ্রাম কমলা চাষের জন্য বিখ্যাত। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কমলা গাছ এবং অর্কিডের বাগান পেয়ে যাবেন। সবুজের মাঝে হেঁটেই ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। পাহাড়ি পথে হাঁটলেই চোখে পড়বে স্থানীয়দের তৈরি বাঁশের সাকো বা ব্রিজ, দুই-একটি গ্রাম্য চার্চ। আর কমলালেবু গাছের বাহার। আক্ষরিক অর্থেই এই এলাকা পাহাড়ের অরেঞ্জ ভ্যালি। এনজেপি স্টেশন থেকে গাড়িতে সেবক হয়ে সিটংয়ের পথ ধরলো গাড়ি। পথের একধারে খাড়াই পাহাড় এবং একধারে অনেকটা নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। শীতের বেলায় এক মনোরম যাত্রা। সিটং যাওয়ার পথেই পড়ে মংপু। কবিগুরুর স্মৃতিবিজরিত মংপুতে একটু ঘুরে যেতে পারেন। আবার ফেরার পথে একদিন কাটিয়ে যেতে পারেন নির্জনতার খোঁজে। মংপু থেকে সিটং সাড়ে আট কিলোমিটার। সিটং পৌঁছলাম ভর দুপুরে। শেষের দিকে রাস্তা বেশ চড়াই, কিছুটা খারাপও বটে। যদিও পাহাড়ি রাস্তা ঠিক করলেও বেহাল হতে সময় নেয় না। সিটং ঢোকার কিছুটা সময় আগে থেকেই দৃশ্যপটে ধরা দিল কমলায় ভরা গাছ। নানান আকারের, কমলার নানান শেডের লেবু গাছে গাছে ঝুলছে। কোনও কোনও জায়গায় দেখলাম কমলা বাক্সে ভরা হচ্ছে। সেগুলি স্থানীয় বাজার হয়ে চলে যাবে শিলিগুড়ির মার্কেটে। এরপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাশাপাশি ছড়িয়ে যাবে বিদেশেও। 


সিটংয়ের উচ্চতা চার হাজার ফুটের কাছাকাছি। ঠান্ডা কিন্তু বেশ বেশি। এর কারণ চারপাশ খোলা উপত্যকা। উত্তরের হিম শীতল হাওয়া হু হু করে বইছে অনবরত। খোলামেলা হওয়ায় চার দিকের পাহাড়ের দৃশ্য বেশ মনোরম। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বাড়িঘর দেখতেও খুব ভালো লাগে। এখানে বেশিরভাগই হোম স্টে। সাজানো গোছানো, কেয়ারি করা ফুল এবং অর্কিডের বাগান। দুই-তিন দিন আরাম করেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। দুপুরের খাওয়া সেরে শেষ বিকেলের মায়াবী সিটং দেখতে হাঁটা লাগালাম। শীতকাল তাই ঝুপ করেই সন্ধ্যে নেমে যায় পাহাড়গুলিতে। চারিদিকে বাহারি অর্কিড, শীতকালীন ফুলের সমাহার। রঙিন প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। দিনের শেষে পাখির দল ঘরে ফিরতে ব্যাস্ত। বেশিরভাগ গাছেই তাঁদের কিচিরমিচির, একটা মন ভালো করা পরিবেশ। ঠান্ডা বেশ ভালোই, কমলালেবুর বাগানে দিন শেষের কাজ গোটানোর ব্যস্ততা। আমাদের ছানাবড়া চোখ দেখে শ্রমিকদের মিটিমিটি হাসি। শেষে একজন কয়েকটি গাছে পাকা টুসটুসে লেবু আমার হাতে তুলে দিলেন হাসিমুখে। শেষ বিকেলের সূর্য মায়াবী হয়ে উঠেছে আকাশে। পাহাড়ে এমনিতেই সন্ধ্যা নামে দ্রুত, ফলে এবার আমাদেরও ঘরে থুড়ি হোটেলে ফেরার পালা। 


এমনিতেই সিটং বেশ মায়াবী, পরিবেশও বেশ নয়নাভিরাম। চারিদিকে কমলালেবুর চাষ অথবা সিঙ্কোনা। তবে কমলার বাগান দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। আর কমলালেবুর ফলন দেখতে হলে আসতে হবে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে। কমলালেবুর ভ্যালি বলা হলেও এই চত্বরে সিঙ্কোনা চাষও বিখ্যাত। এর বাইরে বড় এলাচ সহ সব ধরনের শাকসবজি চাষ হয়। অর্থাৎ চারিদিকে সবুজের সমারোহ। পরদিন হাঁটাপথেই আপার সিটংয়ে একটি পাহাড়ি গুম্ফা দেখতে গেলাম। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার  দারুণ ভিউ পাওয়া যায়। আরেকটা কথা বলে রাখি, সিটং হল পাখির স্বর্গরাজ্য। খুব কাছেই মহানন্দা স্যাংচুয়ারী। একটি গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসা যায় লাটপাঞ্চার, বাগোড়া এবং চটকপুর। আগেই বলেছি মংপুও খুব কাছে। ফলে ঘোরাঘুরি করা যায় আবার পাখির কিচিরমিচির সঙ্গী করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেই সময় কাটিয়ে দিতে পারেন। আমরা দ্বিতীয় পথের পথিক। তবে একটি কমলালেবুর বাগানে ঢুঁ মারলাম। পুরো গ্রামটারই রং কমলা হয়ে যায়। পথ অনেকটা চড়াই, তাই ধীর পায়ে হাঁটাহাঁটি। পথে পেলাম পাহাড়ি দামাল নদী রিয়াং খোলা। শীতকালে কমলালেবুর বাগানে হলুদ হয়ে ফুটে রয়েছে কমলা। দূরে পাহাড়ের কোলে মেঘ। মূলত পাখি প্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। 


মংপু—

সুন্দরী মংপুর মূল আকর্ষণ অবশ্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানেই তাঁর স্মৃতিবিজরিত বাংলোটি আজও প্রধান দ্রষ্টব্য। তবুও প্রাকৃতিক শোভাও নজরকাড়া। কারণ মংপু আজও বড্ড নিরিবিলি। নির্জনতা এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ টান মংপুর ইউএসপি। পাহাড় এখানে যথেষ্ট খোলামেলা, ফলে মেঘ, কুয়াশা, রোদ্দুরের খেলা দেখার মজা মংপুতে একটা দিন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। আগেই বলেছি কবিগুরির স্মৃতি বিজরিত রবীন্দ্রভবন মংপুর বড় আকর্ষণ। তবে মংপুর সঙ্গে সিঙ্কোনার সম্পর্ক আরও নিবিড়। সিঙ্কোনা গাছের ছাল দিয়েই তৈরি হয় জীবনদায়ী ওষুধ কুইনাইন। ফলে কুইনাইন ফ্যাক্টারি দেখাও অনেকটা রথ দেখার পাশাপাশি কলা বেচার মতোই হবে মংপুতে এলে। 



কিভাবে যাবেন?

মূলত তিনদিক থেকে যাওয়া যায় সিটং। সবচেয়ে ছোট রাস্তাটি হল শিলিগুড়ি থেকে সেবক হয়ে ৫৫ কিলোমিটার দূরেই সিটং আসা। আপর পথটি শিলিগুড়ি থেকে সেবক, রামভি ও মংপু হয়ে এবং তৃতীয় পথটি কার্সিয়ং হয়ে। সিটং এবং মংপুতে প্রচুর হোম স্টে এবং রিসর্ট রয়েছে। ইন্টারনেট দেখে বুক করে নিতে পারেন। যদি সম্ভব হয় হোম স্টে বা রিসর্টের সঙ্গে কথা বলে গাড়ি বুক করে নিন সিটং যাওয়ার। এছাড়া নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরেও প্রচুর গাড়ি আছে। দর কষাকষি করে গাড়ি বুক করতে পারেন। কলকাতা-শিয়ালদা এবং হাওড়া থেকে উত্তরবঙ্গ এবং অসমগামী যেকোনও ট্রেনে চেপে চলে আসুন নিউ জলপাইগুড়ি। বিমানপথে বাগডোগড়া হয়েও আসতে পারেন। 


Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post