‘অচেনা’ পুরুলিয়ায় ছৌ মুখোশের গ্রাম ‘চড়িদা’

 
পুরুলিয়া মানেই লাল পলাশ, কৃষ্ণচুড়া, রাধাচুড়ার ব্যকড্রপে ঢেউ খেলানো রাস্তা। ক্যানভাসে আঁকা নীল আকাশের নীচে শাল-পলাশের বন। তবে পুরুলিয়া জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হল ছৌ নাচ। জগ জোড়া যার নাম-যশ। এক বিশেষ ধরনের মুখোশ আর সেইসঙ্গে মানানসই জমকালো পোশাক পড়ে এক নৃত্যকলাকেই ছৌ নাচ বলে। যা কিনা এই পুরুলিয়ার প্রাচীন সংস্কৃতি। আমি আজ বলব এই ছৌ মুখোশের গ্রামের গল্প। চড়িদা গ্রাম, যা বাঘমুন্ডি ব্লকের অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে অবস্থিত।


ছৌ-নাচ বা মুখোশের খ্যাতি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও এই চারিদা গ্রামকে ক জনে চেনেন? অযোধ্যা পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের পর্যটন ক্ষেত্রগুলির পথ নির্দেশক বোর্ড রয়েছে। চড়িদা গ্রামটি চিনিয়ে দেওয়ার তেমন কোনও বোর্ড নেই।
 এমনকী পাহাড়ি পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ মুখোশশিল্প হলেও সরকারিভাবে কোনও প্রচারও নেই। অথচ সরকারি যেকোনও অনুষ্ঠানে ছৌ নাচ দেখা যায়। আর ছৌ নাচের মূল আকর্ষণই তো এই মুখোশ। এই মুখোশই জোগান দেয় চারিদা গ্রাম। এক কথায় বলতে গেলে ছৌ নাচের ধাত্রীগৃহ হল চড়িদা গ্রাম।


কলকাতা থেকে প্রায় ৩০০ কিমি দূরে এই চড়িদা গ্রাম, বাঘমুন্ডি থেকে দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলেই এই চারিদা গ্রাম। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে আসেন, কিন্তু এই চড়িদা গ্রামে যান এমন নিদর্শন খুব কম। প্রায় ২৫০ টি মুখোশ শিল্পী পরিবারের বাস এখানে। ছৌ মুখোশ চরিদা গ্রামের কুটির শিল্প। যদিও অনেক আগে শুধুমাত্র গরীব ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর লোকেরাই এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সম্ভ্রান্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবার সকলেই এই মুখোশ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। এই গ্রামেরই এক শিল্পী গোপাল সূত্রধর। তিনিই জানালেন ছৌ মুখোশ তৈরির পদ্ধতি। এই মুখোশ তৈরি হয় পাঁচটি বিস্তৃত পর্যায়ে আর প্রায় পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে। প্রথম পর্যায়ে স্থানীয় নদীর মাটি দিয়ে মুখোশের আকার দেওয়া হয়। এরপর কাগজের পড়ত লাগানো হয় ওই মাটির মুখের ওপর। অনেক সময় প্রায় পনেরো থেকে কুড়ি খানা কাগজের পড়ত দেওয়া হয় ও রোদে শুকনো হয়। এই সময় যদি বৃষ্টি নামে তবে পুরো পরিশ্রমই বলতে গেলে মাঠে মারা যায়।

এই মুখোশ শুকিয়ে গেলে তার ওপরে বেলে মাটির একটি পাতলা স্তর দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে একটা পাতলা কাপড় বেলে মাটির গোলাতে ভালো করে ভিজিয়ে মুখোশের ওপর চাপানো হয়। এর ওপরেই ধীরে ধীরে চোখ নাক ঠোঁট প্রভৃতির আকার ফুটিয়ে তোলা হয়। এরপর আরেক প্রস্থ ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে কাপড়ের আস্তরণ টা খুব ধীরে ও সাবধানে খুলে ফেলা হয়। এবার খড়িমাটি দিয়ে মুখোশ এর ওপর আস্তরণ দেওয়া হয়। খড়িমাটিতে ক্যালসিয়ামের মাত্রা অনেক বেশি থাকায় মুখোশ আরও শক্ত হয়ে ওঠে। শুরু হয় রঙের পালা।

বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙে মুখোশ রাঙিয়ে তোলাও একটা শিল্প। এর সঙ্গে রংবেরংয়ের পুঁতি, জড়ি, রিবন প্লাস্টিকের ফুল ও পাতা দিয়ে মুখোশকে সাজিয়ে তোলা হয়। এই মুখোশ তৈরি বাঘমুন্ডির রাজা মদনমোহন সিংদেও-র আমল থেকে শুরু হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এখন এখানে শুধু ছৌ নাচের মুখোশই হয় না, নানান মাপের মুখোশ তৈরি করেন এই চড়িদা গ্রামের শিল্পীরা। যেগুলি ঘর সাজানোর কাজে লাগানো হয়। সেগুলি কলকাতা সহ দেশের বড় বড় শহরের দোকানে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এটাকে জীবিকা করেছেন চড়িদা গ্রাম। ছৌ-নাচের দলগুলি যা পারেনি।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post