শিলং-চেরাপুঞ্জি-মাওলিনং

 

আমরা অর্থাৎ বাঙালিরা আদার ব্যাপারি, তাই জাহাজের খোঁজ রাখিনা। তবুও ফি বছর একটু ঘুরতে না বেরোলে মনটাই যেন উড়ুউড়ু করে। এবার তো আবার করোনার ছোবলে লন্ডভন্ড পৃথিবী। তাই বেড়ানো বাতিলই প্রায়। তবে ঘরে বসে মানস ভ্রমণ তো করাই যায়। তাই আপনাদের জন্য মেঘালয়ের অন্দরেই উঁকি দিলাম। উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন-সিস্টার রাজ্যের অন্যতম হল মেঘালয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। পাহার, ঝড়না, হ্রদ, মেঘ ও বৃষ্টি নিয়ে মেঘালয় যেন সত্যিই মেঘের দেশ। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং, যাকে পর্যটকরা আদর করে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলেই ডেকে থাকেন। এর উচ্চতা ৪৯০৮ ফুট। শান্ত ও কোলাহলমুক্ত এই শহরে প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে। ফলে প্রতিটি পর্যটকদের কাছেই খুব জনপ্রিয় শহর শিলং।

শিলং-

শিলংয়ে ঘোরার জায়গা অনেক। পায়ে হেঁটেই ঘুরে নিতে পারেন শহরের অনেক দর্শনীয় স্থান। রয়েছে জাদুঘর, লেক, গল্ফ কোর্স, পার্ক, ঝরনা। প্রথমেই দেখে নিতে পারেন ওয়ার্ড লেক। লেকে যেমন নৌকা বিহারের ব্যবস্থা রয়েছে তেমনই লেকটি ঘিরে রয়েছে সুন্দর সাজানো বাগান (পার্ক)। নানা প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ দিয়ে সুন্দর বাগানটি। শিলং ও মেঘালয়ের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জানতে ঘুরে দেখুন হেরিটেজ, উইলিয়ামসন, ডন বসকো নামে তিনটি জাদুঘর। এছাড়া রয়েছে বিমানবাহিনীর একটি জাদুঘর। পাশাপাশি শিলং শহরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দুটি বাড়ি রয়েছে।

shilong

শিলং পিক থেকে শহরের দৃশ্য

শিলং শহরের আশেপাশে ঘোরার জন্য রয়েছে প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা। তবে নিজেরাও গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিতে পারেন। ছোট মারুতি গাড়ি ভারা পাওয়া যায়, চারজনের দল হলে সুবিধে হয়। শিলং ভিউ পয়েন্ট থেকে শিলং শহর দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ। এটাই শিলংয়ের সর্বোচ্চ পয়েন্ট। শিলংয়ের গল্ফ কোর্সটির দৃশ্য নয়নাভিরাম। পাইন গাছে ঘেরা সবুজ গালিচার এই গল্ফ কোর্সই হল ভারতের প্রথম ১৮ হোল যুক্ত গল্ফ কোর্স। লেডি হায়দারি পার্ক আদতে একটি ছোট চিড়িয়াখানা। বিশেষ করে শিশুদের কাছে এই পার্ক খুবই জনপ্রিয়।

উমিয়াম লেক বা বরাপানি

শিলংয়ের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল উমিয়াম লেক বা বরাপানি। এই উমিয়াম লেককে কেন্দ্র করেই মেঘালয় ট্যুরিজম বিভাগ তৈরি করেছে ওয়াটার স্পোর্টস কমপ্লেক্স। আর সবুজ পাহাড়ে ঘেরা এই লেক অপূর্ব। শিলং থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে বিশপ অ্যান্ড ব্যাডন ঝরনা। এরপর দেখে নিন এলিফ্যান্ট ঝরনা বা হাতি ঝরনা। হাতির আকারের পাহাড় থেকে এই ঝরনার জল নেমে এসেছে বলে এর এমন নাম। এই ঝরনার জল মূলত তিনটি ধারায় নেমে এসেছে। একটু দূর থেকে দেখলে অনেকটাই হাতির মতো মনে হবে। এছাড়া শিলং শহরে রয়েছে পুলিশ বাজার। এখানে কেনাকাটার আদর্শ জায়গা।

এলিফ্যান্ট ঝরনা বা হাতি ঝরনা

চেরাপুঞ্জি-

শিলং থেকে এবার চলুন চেরাপুঞ্জি। এই পথে চললে পথে পড়বে মকডক সেতু। দুটি পাহাড়ের মাঝে এই ঝুলন্ত সেতু দেখতে দারুণ লাগবে। এছাড়া হাতের নাগালেই উড়ে যাওয়া মেঘের দল আপনাকে জানান দেবে আপনি মেঘের আপন আলয়ে প্রবেশ করতে চলেছেন। চারপাশে উঁচু-উঁচু সবুজ পাহাড়। সে পাহাড়ের মাথায় সাদামেঘ উড়ছে। যেন ইচ্ছে হলেই সে মেঘ ধরা যায়। দৃশ্যগুলো সত্যিই চোখ জুড়ানোর মতো। এখান থেকেই সিঁড়ি নেমে গেছে দুয়ানসিং সিয়েম ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে দৃশ্যমান হয় ঘন সবুজ মাডক উপত্যকার মনোরম শোভা। পথে পড়বে নংথাইমাই ইকো-পার্ক। এটি মূলত সেভেন সিস্টার ঝরনা নামেই পরিচিত। এটি দূর থেকেই দেখতে ভালো লাগে। আর রয়েছে একটি রহস্যময় গুহা। প্রায় গোলাকার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এই গুহাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ মিটার। গুহাটি কোথাও সরু আবার কোথাও মোটা। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষজন এই গুহার একমুখ দিয়ে প্রবেশ করে অন্যমুখ দিয়ে বের হন।

মোসামাই কেভ বা গুহা

চেরাপুঞ্জি শহরে ঢোকার মুখে পড়ে ওয়াকাবা ফলস বা ঝরনা। চারিদিক উন্মুক্ত আর পাহাড়ের গা বেয়ে বিনুনির মতো নীচে নেমে এসেছে সরু জলধারা। চেরাপুঞ্জি হল বিশ্বের সর্বাধিক বর্ষণের এলাকা। তাই মেঘ ও বৃষ্টির খেলা এখানে প্রায়ই চলে। খাসি পাহাড়ে বাধা পেয়ে চেরাপুঞ্জি ও মৌসিনরামে প্রায় সারা বছরই অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে। খাসি পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে শুধুমাত্র মৌসিনরামেই বছরে প্রায় ২৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। চেরাপুঞ্জি শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য রামকৃষ্ণ মিশন। রামকৃষ্ণ মিশনের নৃতাত্বিক সংগ্রহশালাটি  অসাধারণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের উপজাতীয় মানুষদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায় এখানে। এরপর দেখুন নহকালিকাই ফলস বা ঝরনা। প্রায় এক হাজার ফুট উঁচু থেকে ঝরনার জল আছড়ে পড়ে নীচে। অনেকটা খোলা জায়গায় এই ঝরনা অসাধারণ দৃশ্যপট তৈরি করে।

মৌসিনরামে বৃষ্টি

অনেক নীচে সৃষ্টি হয়েছে ছোট জলাশয়। স্নিগ্ধ নীল তার রং। হাজার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া যায় জলাশয়ের কাছে। তবে ভরা বর্ষায় এই ঝরনা আরও অপরূপ হয়ে ওঠে। এখান থেকেই দেখা যায় একপাশের বাংলাদেশ। আকাশ পরিস্কার থাকলে পড়শি দেশের অনেকটাই দৃশ্যমান হয়। শহরের মাঝখানেই রয়েছে ১৫৭ বছরের পুরনো প্রেসবিটারিয়ান চার্চ। চেরাপুঞ্জি শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি মনোরম ইকো পার্ক। এখানে রয়েছে অসংখ্য ফুল, অর্কিড ও ফল গাছের সমাহার। তবে এই শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হল মোসামাই কেভ বা গুহা। এই প্রাকৃতিক গুহাটির অবস্থান একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। ফলে এই গুহা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আপনাকে যৌবনের অ্যাডভেঞ্চারে পৌঁছে দেবে। বর্তমানে এই গুহায় অবশ্য বৈদ্যুতিন আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কখনও বসে, কখনও সরু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে শরীরকে গলিয়ে এগিয়ে যেতে হয় গুহার ভিতর। গুহার এক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে অন্য মুখ দিয়ে বের হতে হবে।

পাহাড়ি ঝরনা

ভিতরে রয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্টি অসংখ্য ভাস্কর্য। কখনও মানুষের মুখ, কখনও হাঁস বা পাখির মূর্তি ফুটে উঠেছে প্রাকৃতিক উপায়ে। তবে চেরাপুঞ্জির অন্যতম আকর্ষণ হল ডবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ। জৈবপ্রযুক্তিতে প্রাকৃতিক উপায়েই তৈরি এই সেতু বহু প্রাচীন। ত্যারণা গ্রাম থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে  সিঁড়িপথে হেঁটে ২,৪০০ ফুট নীচে নেমে পৌঁছতে হবে উমশিয়াং নদীর ওপর তৈরি এই বিস্ময়কর সেতুর কাছে। রবার গাছের শিকড় পেঁচিয়ে এই সেতুর সৃষ্টি। মেঘালয় ছাড়া পৃথিবীতে কোথাও আর এই অসামান্য প্রাকৃতিক শৈলী দেখা যায় না। এছাড়া চেরাপুঞ্জির অন্যান্য দ্রষ্টব্য হল কেইনরেম ফলস, খো-রামা, সাংকারাংগ পার্ক, মোসামাই ফলস, ডাইনথলেন ফলস, নংগিথিয়াং ফলস প্রভৃতি।

ডবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ

মাওলিনং -

এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামের শিরোপা অর্জন করেছে এই গ্রাম। শিলং থেকে দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। শিলং থেকে অনেকটা পথ যাওয়ার পর পথ দুটি ভাগে ভাগ হয়েছে। একটি চলে যায় চেরাপুঞ্জির দিকে অন্যটি দাউকি ভ্যালি। এই দ্বিতীয় পথ ধরেই মাওলিনং যেতে হয়। দাউকি থেকে ১৮ কিমি দূরেই এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। পথের দু’পাশে লম্বা লম্বা ঘাসের বন দেখা যায় যা থেকে ফুলঝাড়ু তৈরি হয়। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি পরিপাটি করে সাজানো। বাড়ির সামনে রয়েছে ফুলের বাগান। পাশাপাশি প্রতিটি বাড়ির সামনে ও রাস্তায় থাকে বেতের তৈরি ডাস্টবিন। এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামের খেতাবটি ধরে রাখতে গ্রাম সমিতি ও গ্রামবাসীরা খুবই সচেষ্ট। এছাড়া বাড়িগুলির প্রবেশ দরজা, সীমানা বেড়া-সবই সুন্দর লতানে ফুলগাছে মোড়া। এক কথায় রূপকথার গ্রাম। এখানেই দেখতে পাবেন ‘ব্যালান্সিং রক’। ছোট্ট এক টুকরো পাথর বিশাল এক গোলাকার প্রস্তরখণ্ডকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কিছু, টলাতে পারেনি বিশাল এই পাথরটিকে।

ডবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ

কীভাবে যাবেন?

মেঘালয়ে কোনও ট্রেনলাইন নেই। তবে এখন শিলং পর্যন্ত রেল লাইন বসানোর কাজ চলছে। তাই আপাতত গুয়াহাটি হয়েই যেতে হয়। গুয়াহাটি থেকে অসংখ্যা ছোট, বড় গাড়ি এবং বাস যায় শিলং। আর মেঘালয়ের রাজধানী শহর থেকে চেরাপুঞ্জি সহ অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে যাওয়া গাড়ি পাবেন। অথবা মেঘালয় ট্যুরিজমের কন্ডাক্টেড ট্যুরের বাসে দিনে দিনে চেরাপুঞ্জি ও মাওলিনং দেখে নেওয়া যায়।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post