ভূত চতুর্দশী এবং চোদ্দো শাক, কী এবং কেন?

‘একে শুক্কুরবার, তায় তেরো তারিখ, এর ওপর ভূত চতুর্দশী, সর্বোপরি সালটা ২০২০, ফলে ভালোয় ভালোয় দিনটা কাটলে হয়’। শুক্রবার ভূত চতুর্দশী বা প্রেত চতুর্দশী। এর আগেই সোশাল মিডিয়ায় এই ধরনের নানা রসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আদতে এই ভূত চতুর্দশী কী? এর মানেই বা কী? বাঙালি হিন্দুদের মতে এই দিনে তাঁদের পরলোকগত পিতৃপুরুষেরা মর্তে নেমে আসেন। 

 

তাই বেশিরভাগ বাঙালি পরলোকগত পিতৃপুরুষের আত্মার সদ্গতির কামনায় বহু কাল আগে থেকে চলে আসা এই প্রথাকে খুব সাড়ম্বরে পালন করে থাকেন। দীপান্বিতা অমাবস্যার আগে চতুর্দশী তিথিতে হিন্দুমতে ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়। পুরাণমতে দানবরাজ বলি যখন স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করে নিলেন তখন নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করল রাক্ষসরা। এই আক্রোশ থেকে পার পেলেন না দেবতারাও। 

 


বলির তাণ্ডব ঠেকাতে দেবগুরু বৃহস্পতি ভগবান বিষ্ণুকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। বামনের ছদ্মবেশে তখন নেমে এলেন শ্রীবিষ্ণু, তিন পা সমান জমি ভিক্ষা চাইলেন রাক্ষস রাজা বলির কাছে। দানবরাজ কিন্তু প্রথমেই বুঝে নিয়েছিলেন এই বামন আর কেউ নন, স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু। কিন্তু দম্ভের বশে তিনি রাজি হলেন চুক্তিতে। বামন অবতারে বিষ্ণু দুই পা দিয়ে স্বর্গ ও মর্ত্য দখল করেন। এরপর নাভি থেকে বের হয়ে এলো তাঁর তৃতীয় পা, যা রাখলেন বলিরাজার মাথার উপর।

 

 সঙ্গে সঙ্গেই পাতালে নেমে গেলেন দানবরাজ বলি। সেই থেকে পাতালই হল তাঁর আবাস। তবে জেনেশুনে জমি দান করায় এবং ভগবানের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করায় বলিকে কিছু করুণাও করলেন বিষ্ণু। প্রতিবছর পৃথিবীতে তাঁর পুজো হবে বলে আশীর্বাদ করলেন তিনি। সেই থেকে কালীপুজোর আগের রাতে বলিরাজা পাতাল থেকে উঠে আসেন পুজো নিতে। সহচর হিসেবে থাকে শত সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা এবং অশরীরীরা।





কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে হয় কালীপূজা। তার ঠিক আগের রাত, অর্থাৎ আজ, হলো ভূত চতুর্দশী। বাঙালিরা এদিন চদ্দো শাক খেয়ে এবং চোদ্দ প্রদীপ জ্বেলে পরলোকগত চোদ্দো পুরুষকে স্মরণ করেন। আবার ভূত মানে হল অতীত, ভূত হল আত্মা, তাই এই দিনটিকে ভূত চতুর্দশী বলা হয়। এই দিনটি অনেকটা পশ্চিমী দেশগুলির হলোউইন ডে-র মতো। আজকের দিনটি ধর্মীয় মানুষের কাছে খুবই আতঙ্কের। পশ্চিমীদেশগুলির মানুষজন মনে করে ‘FRIDAY THE 13’ বা ১৩ তারিখে শুক্রবার পড়লেই ভূতের আগমন হয়। 

 

অনেকেই বাড়ির সামনে মোমবাতি জ্বেলে তাই ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। তবে ব্রিটেনে এই ‘ফ্রাইডে দ্যা থার্টিন’ তৈরিই হয়েছিল নেপোলিয়নের ফ্রান্সকে ধংস করার পর।  অনেকটা একই কারণে প্রাচীন বঙ্গে ভুত চতুর্দশী পালন শুরু হয়। বলি রাজার অনুচররা যাতে যত্রতত্র ঢুকে না পড়েন, তার প্রতিকার করতেই এই ব্যবস্থার প্রচলন। চতুর্দশী তিথির ভরা অমাবস্যায় চারিদিক নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থাকত। সেই অন্ধকার দূর করতে এবং চোদ্দো পুরুষকে স্মরণ করতেই প্রদীপ জ্বালানো হতো।




কিন্তু চোদ্দো শাক খাওয়ার প্রচলন কেন? শাক খাওয়া বাঙালির এক ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। আর নানাবিধ রোগ হরণকারী এই ১৪টি শাক একত্রে ভক্ষণ করে বাঙালি পিতৃপুরুষদের স্মরণ করেন। এই ১৪টি শাক হল, ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং শুষনী। যদিও বর্তমানে এর অনেকগুলিই সহজলভ্য নয়। তবুও প্রাচীন এই রীতিনীতি আজও রয়ে গিয়েছে। আগামীকাল দীপান্বিতা অমাবস্যা, রাজ্যজুড়েই হবে কালীপুজো। যদিও এবার করোনা আবহে পুজোর জাঁকজমক অনেকটাই কমবে। তবুও গড়পড়তা বাঙালি আবেগের বশ।

 

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post