নির্জনতাকে সঙ্গী করে মনের মানুষকে নিয়ে ঘুরে আসুন আদিম আন্দামানে (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্বে আমরা আন্দামানের রাজধানী শহর পোর্ট ব্লেয়ার এবং আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলি সম্পর্কে জেনেছিলাম। এবার আমাদের গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ারের অদূরে দুটি অসাধারণ সুন্দর দ্বীপে। এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাসও কথা বলে।

রস ও ভাইপার আইল্যান্ড-

পরদিন স্টিমারে চেপে বঙ্গোপসাগরের জলে ভেসে পড়া গেল। গন্তব্য রস আইল্যান্ড। ব্রিটিশ আমলে এখানে কলোনী গড়ে তুলেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে আসা রাজ কর্মচারিরা। রস আইল্যান্ড যেন অতীতের ব্রিটিশ কলোনীর এক ভগ্নচিত্র। সেই গথিক স্টাইলে নির্মিত বাড়িঘর, গীর্জা, সমাধিস্থল যেন ব্রিটেনের এক ছোট্ট গ্রামের ভগ্নদশা। সেগুলি দেখার ফাঁকেই চোখে পড়বে ইতিউতি হরিনের ছোটাছুটি। নিস্প্রাণ ও প্রাণের সহাবস্থান। ঘন্টাখানেক দেখাদেখি করেই ফের স্টিমারের পেটে সেঁধিয়ে বসলাম। এবারের গন্তব্য ভাইপার আইল্যান্ড। এটিও ভগ্নপ্রায় ব্রিটিশ কলোনী, তবে অতীতের এক ভয়ানক সুনামীর ক্ষতচিহ্ন এই দ্বীপের অলিতে গলিতে দেখা যাবে। সেই ভয়ঙ্কর ক্ষত নিয়েই দ্বীপটি কোনও রকমে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। 

এখানেই রয়েছে বীর আফগান যোদ্ধা সের আলির ফাঁসিঘর। যা আজও অনেকটা অক্ষত, যেন মুচকি হেসে ব্যঙ্গ করে বলছে দেখ পাপের শাস্তি কেমন লাগে! ফের স্টিমারে ওঠার পালা। আন্দামানে এখানে সেখানে ঘুরতে হলে স্টিমার অথবা জাহাজে উঠতেই হবে। এবারের গন্তব্য নর্থ বে, এই দ্বীপেই রয়েছে বিখ্যাত লাইট হাউস। এখন আর ২০ টাকার নোট পাওয়া যায়না, যারা দেখেছেন তাঁরা হয়তো খেয়াল করেছেন পুরোনো ২০ টাকার নোটে এই বিখ্যাত লাইট হাউসের ছবি। এখানকার অপরূপ সুন্দর বিচে চাইলে স্নানও করে নিতে পারেন। লাইট হাউসকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে নারকেল গাছের সারি দেওয়া শান্ত বিচে সূর্যাস্ত দেখে ফিরে আসুন পোর্ট ব্লেয়ারের আস্তানায়।


হ্যাভলক ও নীল আইল্যান্ড-

পরদিন সকালেই পৌঁছে গেলাম পোর্ট ব্লেয়ারের জাহাজঘাটায়। এখান থেকে মাঝারি মাপের সাধারণ ও বিলাসবহুল ক্রুজ প্রতিদিনই ছাড়া হ্যাভলক ও নীল দ্বীপের জন্য। পকেটের সাধ্য অনুযায়ী টিকিট কেটে চেপে বসলেই হল। আগেই বলেছি এই দ্বীপদুটি হানিমুন ডেস্টিনেশন বিসেবে বেশ জনপ্রিয়। তাই জাহাজে বা ক্রুজে নবদম্পতিদের হামেশাই দেখা মিলবে। তাই দারুণ কিছু এলাকা দেখার উদ্দেশ্যে উত্তাল সমুদ্রের বুকে ভেসে পড়া আর কি। হ্যাভলক আইল্যান্ড পোর্ট ব্লেয়ার থেকে প্রায় ৩০ কিমি দূরে, ফলে পৌঁছাতে লেগে যায় ঘন্টা দুয়েক। এই দ্বীপ হল কোরালের স্বর্গরাজ্য। স্বচ্ছ কাঁচের মতো জলের তলায় অসংখ্য কোরাল ও রঙিন মাছের ইতিউতি ঘোরাঘুরি। অনেকটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলে দেখা সেই অপরূপ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যাবে এখানে। স্পিড বোটে বা ইঞ্জিন লাগানো বিশেষ নৌকায় গায়ে লাইফ জ্যাকেট চাপিয়ে বসে পড়ুন। এরপরই সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়িয়ে নৌকার পাদানির কাছে লাগানো কাঁচের পাটাতন দিয়ে দেখতে থাকুন কোরালের জঙ্গল ও তাতে রঙিন মাছেদের দলবদ্ধ ঘোরাঘুরি। 

এছাড়া হ্যাভলকে রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত কয়েকটি অসাধারণ সি-বিচ। এরমধ্যে রাধানগর বিচ পৃথিবীর প্রথমসারির সি-বিচ গুলির মধ্যে প্রথম দিকেই রয়েছে। যেমন তার সৌন্দর্য, তেমনই কাঁচের মতো স্বচ্ছ টলটলে জল। ঠিক যেন সুইমিং পুল। মনের আনন্দে স্নান করুন। এছাড়া সাগরের জলের যে এত রকম রঙ হতে পারে সেটা এখানে না আসলে জানতেই পারবেন না। গাঢ় নীল, হালকা নীল, আকাশি নীল, পান্না সবুজ রঙের পরত এখানকার জলে। এর কারণ অবশ্য কোরালের আধিক্য। কোরালের রঙেই জলের রঙের রকমফের। রাধানগর বিচ ছাড়াও রয়েছে গোবিন্দনগর বিচ, বিজয়নগর বিচ, এলিফেন্ট বিচ প্রমুখ। বিচগুলির পাশেই নারকেল ও ঝাউবন। শান্ত ও নির্জন এই দ্বীপে একমাত্র সঙ্গী পাখির কলতান। ফলে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবেই আপনাকে। রাতের হ্যাভলকেরও আরেক রূপ। এখানে দিনে ও রাতে নির্দিষ্ট সময় লোডশেডিং হয়। কারণ পুরো আন্দামানে কোনও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। ডিজেল পুড়িয়ে জেনারেটরের সাহায্যেই আলো-পাখার ব্যবস্থা এখানে। লোডশেডিংয়ের সময় দূষণহীন আকাশে তারার আধিক্য আপনাকে নিশ্চিত ভাবেই আকৃষ্ট করবে। পরদিন ফেরার পথে ঘুরে দেখলাম নীল আইল্যান্ড। ইংরেজদের দেওয়া নাম হলে কি হবে? 

এই দ্বীপভূমি যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশী শরণার্থীদের এখানেই পুনর্বাসন দেয় ভারত সরকার। প্রত্যেকের ভাগেই ২০ বিঘা করে জমি দেওয়া হয়েছিল। যেগুলি নিজেদের ঘাম ও রক্ত দিয়ে সুজলা-সুফলা করে তুলেছেন বাঙালিরা। ফলে এখানে কোনও ভিখারি খুঁজে পাবেন না। জমিতে অফুরন্ত ফসল, নারকেল, সুপারি আর সমুদ্রে অফুরন্ত মাছ। প্রকৃতি যেন এখানে গর্ভবতী মায়ের রূপ ধরে অবস্থিত। পাশাপাশি এখানে কোরাল রিজ, ন্যাচারাল ব্রিজ ও কয়েকটি ভার্জিন বিচ রয়েছে। নির্জন এই দ্বীপ কেন নবদম্পতিদের কাছে স্বর্গরাজ্য সেটা এখানে এলেই বুঝতে পারবেন। একবেলা কাটিয়ে সন্ধ্যার মুখে পোর্ট ব্লেয়ারের জাহাজ ধরলাম। সেদিন ছিল আমাবস্যা, তাই সমুদ্রের রুদ্ররূপের একটা চোট্ট ট্রেলার দেখলাম জাহাজের ডকে বসে। আপনারাও আমাবস্যা অথবা পূর্ণিমার দিন এই পথে ফেরার প্ল্যান করতে পারেন।

Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post