মন্দিরনগরী কালনা, একদিনেই ঘোরা যায় টেরাকোটার সাম্রাজ্য

শীতের বেলায় অনেকেই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেন। কলকাতা শহরের আশেপাশে এই বাংলার বুকে এমন অসংখ্য জায়গা আছে যেখানে দিনের দিনে ঘুরে বাড়ি ফেরা যায়। এর বেশিরভাগই ঐতিহাসিক দিক থেকে সমৃদ্ধ। সেইসঙ্গে গ্রাম বাংলার সবুজ-সতেজ বাতাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে শহরের ইট-বালি-কংক্রিটের জঙ্গলে ফিরতে পারবেন। এরকমই একটি জায়গা কালনা। যা বাংলার প্রচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। ভাগীরথী নদীর তীরে কালনা শহর, নদীর অপর পাড়ে নদিয়ার শান্তিপুর। কালনা পুরসভারই প্রতীষ্ঠা হয়েছিল সেই ১৮৬৯ সালে। আর এর ইতিহাস তো কয়েক শতাব্দী প্রাচীন। যেকোনও ছুটির দিনে শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে সকালের ট্রেন ধরে চলে আসুন কালনায়। এরপর দিনভর ঘোরাঘুরি করে ইতিহাসের গন্ধ গায়ে মেখে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিয়ে বিকেলের ট্রেনে ফিরে আসুন নিজের ডেরায়। ১০৮ শিবমন্দির, কালনা রাজবাড়ি, প্রতাপেশ্বর মন্দির, রাসমঞ্চ, পঞ্চরত্ন মন্দির, লালজি মন্দির ও অনন্তবাসুদেব মন্দিরের মতো দেখার মতো অসংখ্য জায়গা আছে প্রচীন কালনায়। 

ভাগীরথীর তীরে ‘অম্বা মুলুক’ বা ‘অম্বা’ একসময় উল্লেখযোগ্য নদীবন্দর ছিল। যা কালের নিয়মে আজ অম্বিকা কালনা বা কালনা নামেই পরিচিত। পনেরোশো-ষোলশো শতক পর্যন্ত ‘অম্বা মুলুক’ নামেই পরিচিত ছিল কালনা। মঙ্গলকাব্যেও এই নামের উল্লেখ আছে। কালনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে মূলত চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরেই। ষোড়শ শতকে এখানে আগমন ঘটেছিল শ্রী চৈতন্যের। তবে কালনার অধিকাংশ মন্দিরের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছিল আঠারোশে থেকে উনিশ শতকের মধ্যে। সেটাও বর্ধমানের মহারাজার হাত ধরেই। জানা যায় বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্র বাহাদুরের সময়েই কালনায় একাধিক মন্দির স্থাপিত হয়েছে। একসময় বর্ধমান রাজাদের গ্রীষ্মকালীন আবাস ছিল এই কালনা নগরীতেই। তবে সকলেই একমত অম্বিকা কালনা নামটি এসেছে মা অম্বিকা বা দুর্গার নাম থেকেই। আর একটি বিষয় না বললেই নয়, সেটি হল মন্দিরগুলিতে টেরাকোটার প্রাচুর্য। বিশেষজ্ঞদের মতে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের থেকে কালনার মন্দিরের টেরাকোটা অনেকটাই ‘বিশুদ্ধ’। 

কালনা ১০৮ শিবমন্দির

কালনাকে বলা হয় মন্দির নগরী। কারণ এখানে বহু মন্দির রয়েছে, যারমধ্যে বেশিরভাগই পোড়ামাটির টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ। কালনার মন্দিরের কথা বললে প্রথমেই আসে ১০৮ শিবমন্দিরের নাম। কালনা রেল স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করেই পৌঁছে যাওয়া যায় এই মন্দিরে। যা নবকৈলাশ মন্দির নামেও পরিচিত। জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজা তেজ চন্দ্র বাহাদুর ১৮০৯ সালে এই ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। আটচালা স্টাইলে অপরূপ টেরাকোটার কাজে এই মন্দিরগুলি অবশ্য দ্রষ্টব্য। দুটি বৃত্তে এই মন্দিরগুলি তৈরি করা হয়েছে। ভিতরের বৃত্তে রয়েছে ৩৪টি শিবমন্দির, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত শিব লিঙ্গগুলি সাদা। এবং বাইরের বৃত্তে রয়েছে ৭৪টি শিবমন্দির, যার মধ্যে রয়েছে কালো শিব লিঙ্গ। মন্দিরের প্রত‍্যেকটি শিবলিঙ্গ উওরমুখী এবং শিবলিঙ্গগুলির অবস্থানও কিছুটা ভিন্ন। মন্দির প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা একটি এক জলাধার রয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে ৩৪টি শিবলিঙ্গ একসাথে দেখা যায়।

কালনা রাজবাড়ি

১০৮ শিবমন্দিরের কাছেই রয়েছে কালনা রাজবাড়ি। এই কমপ্লেক্সে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার মন্দির। আর প্রবেশদ্বার পেরিয়েই প্রথমে চোখে পড়বে একটি প্রাচীন কামান। প্রবেশদ্বারের একপাশেই দেখবেন প্রতাপেশ্বর মন্দির। যেটি তৈরি করিয়েছিলেন মহারাজা প্রতাপচাঁদের স্ত্রী, তাঁর স্বামীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির অপূর্ব কারুকার্য মন ভরাতে বাধ্য। কালনায় যতগুলি টেরাকোটার মন্দির রয়েছে তার মধ্যে এই প্রতাপেশ্বরের মন্দিরটি শ্রেষ্ঠ। মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন দেবদেবী, পৌরানিক কাহিনী ও সমকালের মানুষের জীবনযাত্রার কাহিনী অলংকৃত হয়েছে। প্রতাপেশ্বর মন্দিরের পাশেই রয়েছে রাসমঞ্চ। যা কালনা রাজবাড়ির এক অন্যতম নিদর্শন। একসময় এখানে রাস উৎসব পালিত হত। 

আজ এই রাসমঞ্চ অতীতের স্মৃতি নিয়ে ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। এর কিছুটা দূরেই রয়েছে লালজী মন্দির। ২৫টি চুড়া বিশিষ্ট এই মন্দির দেখতে অনেকটা রথের মতো। তিনটি স্তরে রয়েছে এই ২৫টি চুড়া। এই মন্দির গাত্রেও রয়েছে অপরূপ টেরাকোটার কাজ। যদিও আজ এর অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবুও Archaeological Survey of India মন্দিরটি দেখভাল করে কিছুটা হারানো গৌরব ফিরিয়ে এনেছে। জানা যায়, ভারতের প্রধান পাঁচ পঁচিশরত্ন মন্দিরের মধ্যে কালনার লালজী মন্দির অন্যতম প্রাচীন। ১৭৩৯ সালে মন্দিরটি নির্মাণ করান বর্ধমানের মহারানী ব্রজকুমারী দেবী। লালজী মন্দিরের পাশেই রয়েছে নারায়নশিলা মন্দির। এখানে ১০৮টি শালগ্রাম শিলা রয়েছে। বামদিকে আরেকটু এগোলেই দেখা যাবে পঞ্চরত্ন মন্দির। পরপর পাঁচটি আটচালা মন্দির নিয়ে তৈরি হয়েছে পঞ্চরত্ন মন্দির। প্রত্যেকটিতেই শিবলিঙ্গ রয়েছে। স্থাপত্যের বিচারে এই মন্দিরের গুরুত্ব কম নয়। এছাড়াও কালনা রাজবাড়ির ভিতরে রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির। এটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৫১-৫৫ সালের মধ্যে। ২৫ চুড়া বিশিষ্ট এই মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ রয়েছে। 

অন্যান্য দ্রষ্টব্য

কালনা রাজবাড়ি দেখা হয়ে গেলে এবার কালনা শহরের অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থান দেখে নিন। একটি টোটো ভাড়া করেই দেখে নিতে পারেন বেশ কয়েকটি অসাধারণ মন্দির। প্রথমেই যাওয়া হল ভবা পাগলার মন্দির দেখতে। ১৯৫১ সালে বাংলাদেশ থেকে জাপট গ্রামে এসে ভবানী মন্দির তৈরি করেছিলেন ভবা পাগলা। শুধু সাধন-ভজনই নয়, এই মন্দির ছিল তাঁর সাহিত্য চর্চার জায়গাও। এই মন্দিরে বসেই তিনি অনেকগুলি গান ও কবিতা লেখেন। জানা যায়, এখনও পর্যন্ত ভবা পাগলার ২৫ হাজার গানের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। প্রতি বছর মে মাসে এখানে উৎসব হয়। দূর দূরান্ত থেকে আসেন বহু বাউল, কবিয়াল ও কীর্তনের দল। এরপর দেখে নিন কালনার মুখ্য আকর্ষণ অনন্ত বাসুদেব মন্দির। এটি আটচালা রীতিতে তৈরি প্রাচীন বাংলার শৈল্পিক কর্মের অনন্য নিদর্শন। এখানে ভোগের ব্যবস্থাও আছে। দেখে নিতে পারেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, এটিই কালনার বিখ্যাত কালীমন্দির। এর আরেক নাম অম্বিকা কালীমন্দির। জনশ্রুতি এই অম্বিকাদেবীর নামানুসারেই অম্বিকা কালনা নাম এসেছে। মূল মন্দিরটি জোড় বাংলা রীতিতে তৈরি। এরপর দেখে নিন শ্যামচাঁদ বাড়ি। এই মন্দিরটি একেবারেই মিস করা উচিত হবে না। আটচালার মন্দিরের সামনেই চারচালার মণ্ডপ রয়েছে। বাঁদিকে রয়েছে দোলমঞ্চ। কালনার ডাঙাপাড়াতে এই অপরূপ সুন্দর মন্দিরটি রয়েছে। সবশেষে দেখে নিন, মহাপ্রভুর মন্দির ও শ্যামসুন্দর মন্দির।  

কীভাবে যাবেন? 

হাওড়া থেকে সরাসরি কাটোয়া যাওয়ার লোকাল ট্রেন ধরে কালনা স্টেশনে নামবেন। এছাড়া ব্যান্ডেল স্টেশন থেকেও কাটোয়া যাওয়ার ট্রেন পাবেন। আর যারা শিয়ালদা শাখায় থাকেন, তাঁদের জন্য শিয়ালদা থেকে সকালে একটিই ট্রেন রয়েছে যেটি বিকেলে শিয়ালদা ফেরে। কালনা স্টেশন থেকে টোটো বা মোটর লাগানো রিকশা ভাড়া নিয়ে গোটা শহর দেখে ফের স্টেশনে ফিরে ট্রেন ধরতে পারেন। বা আলাদা আলাদা করেও নিজের মতো ঘোরা যায়। 










Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post