নির্জনতা চান? ঘরের কাছেই ‘ওড়িশার কাশ্মীর’ দারিংবাড়ি

জানেনই তো বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। আর যাদের পায়ের তলায় সর্ষে আছে, তাঁদের চার দেয়ালের মধ্যে বেঁধে রাখে কার সাধ্যি? কিন্তু বাঁধ সাধছে কালন্তক মহামারি 'করোনা ভাইরাস' সংক্রমণ। ফলে বিগত এক বছরের বেশি সময় মানুষ কার্যত গৃহবন্দী। তবে প্রকোপ কিছুটা কমায়, গত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে অনেকেই একটু ঘুরে এসেছেন কাছেপিঠে বা একটু দূরে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় সে গুঁড়ে বালি। তাবলে কি ঘরে বসে মানস ভ্রমণ করা যায় না? তাই আজ চলুন ওড়িশার দারিংবাড়ি। একে ওড়িশার কাশ্মীর বলে ভ্রমণপিপাসু মানুষজন। প্রকৃতি এখানে নিজ হাতে তাঁর সুধা ঢেলে দিয়েছে যেন। শান্ত, কোমল, সিগ্ধ এক পাহাড়ি জনপদ দারিংবাড়ি। 

দারিংবাড়ি- ওড়িশার কাশ্মীর

 
এখানে যাওয়ার একমাত্র রেল স্টেশন ওড়িশার বেরহামপুর বা ব্রহ্মপুর। হাওড়া থেকে রাতের ট্রেন ধরলে সকালের দিকেই বেরহামপুর পৌঁছনো যায়। স্টেশনে নেমেই দূরে পাহাড়ের ছায়াছবি দেখতে পাবেন। ফলে ভালোলাগার শুরু সেখান থেকেই। পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা, ড্যাম, আদিবাসী গ্রাম মিলিয়ে ওড়িশার এই অঞ্চল ধীরে ধীরে পর্যটকদের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক কারণে প্রখর গ্রীস্মেও গরম এখানে অনেকটাই নরম।
বেরহামপুর থেকে গাড়িতে দারিংবাড়ি যাওয়ার পথেই কয়েকটি জায়গা দেখে নিতে পারেন। প্রথমেই পাবেন সোরাদা ড্যাম এবং তার পাশেই ঘুঁটেশ্বরী মন্দির। তবে পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে উঠতে হবে। সোরাদা ড্যামের বিশাল জলাধার, আর তাঁর পাশে অনুচ্চ পাহাড়ের সারি। হওয়ায় দোল খাওয়া জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালোই লাগবে কথা দিলাম। আরও কিছুটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঘুঁটেশ্বরী মন্দিরের চাতাল। এখানে লক্ষ্মী, দুর্গা এবং কালী এক আসনে ও একসাথে পূজা পান। মন্দিরের চাতাল থেকেই দূরে দেখা যায় ঋষিকুল্লা নদী। শান্ত পরিবেশে পাখিদের কিচিরমিচির শহুরে চিন্তা কখন যে মন থেকে মুছে যাবে, বুঝতেও পারবেন না। আরও একটু উপরে উঠলে ভিউ পয়েন্ট, সেখান থেকে পুরো ড্যাম সহ উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্য মনভোলানো। এখানেই বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। তবে তাবলে অনন্তকাল নয়, হোটেলেও তো পৌঁছাতে হবে। এখনও অনেক দেখা বাকি। 


 এমু পাথি


 ফলে এবার দারিংবাড়ি হোটেলের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি ছোট রাস্তা ধরলো গাড়ি, শুরু হল জঙ্গলের পথ। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি নিজেকে নিজের মতো করেই সাজিয়ে রেখেছে। লাল পাথুরে মাটির ওপর সবুজের জঙ্গল, ঠিক যেন প্রাকৃতিক ক্যানভ্যাস। দুপুরে দুটোর মধ্যে হোটেল পৌঁছে গেলাম। বলে রাখি, দারিংবাড়িতে এখন বহু হোটেল, রিসর্ট ও হোম স্টে রয়েছে। গাড়ির জন্য তাঁদের বলে দিলেই ভালো। তবে বেরহামপুর স্টেশনে দরদাম করেও গাড়ি বুক করে দারিংবাড়ি যেতে পারেন। হোটেলগুলির আশেপাশেই রয়েছে নেচার্স পার্ক আর হিল ভিউ পয়েন্ট। চারিদিকে সবুজের সমাহার। এই নেচার্স পার্কে রয়েছে স্থানীয় কয়েকটি আদিবাসী সমাজের, জীবনযাত্রার নিদর্শন। সন্ধ্যে পর্যন্ত পায়ে হেঁটেই ঘুরে ঘুরে দেখে নেওয়া যায়। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে আদিম প্রকৃতির কোলে ঘুমের দেশে। এই সবুজ রঙের উপত্যকাটিকে বলা হয় ‘সাইলেন্ট ভ্যালি অফ ওড়িশা’।

 দারিংবাড়ির পথে

পরদিন দারিংবাড়ি ভ্রমণ। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করেই বেড়িয়ে পড়লাম। দারিংবাড়ির আনাচে কানাচে হারিয়ে যাওয়ার দিন। পাহাড়ের মাঝেই জঙ্গলের পথ, মাঝেমধ্যেই আদিবাসীদের গ্রাম। গ্রামের মধ্যেই একফালি জমিতে কোথাও ভুট্টা, কোথাও রাগি বা সবজির চাষ হচ্ছে। আবার কোথাও জঙ্গলে মোষের দল এঁকেবেঁকে চলেছে লাল মাটির পথ ধরে। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে প্রথমে এলাম মন্দাসরু। এখানে আছে একটি সুন্দর ইকো পার্ক। ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা মিলল একটার পর একটা সাজিয়ে রাখা পাহাড়ের ঢেউ। দূরে দেখা যাচ্ছে ম্যাগনেটিক হিল। এর বিশেষত্ব হল কেউ যদি চেঁচিয়ে নিজের প্রিয়জনের নাম ধরে ডাকেন, সেই আওয়াজ পাহাড়ের গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে ঠিক ফিরে আসবে আপনার কাছেই। কিছুটা নীচে রয়েছে নাম না জানা অসংখ্য ঝর্ণা। যদিও তাঁদের কাছে পৌঁছাতে হলে পাহাড়ি হাঁটা পথে অনেকটাই (প্রায় দেড়-দুই ঘন্টা) যেতে হবে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে এটা অবশ্যই বাড়তি পাওনা। আমি অবশ্য মন ভরিয়ে প্রকৃতিকে দেখে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে চললাম পরের গন্তব্যের দিকে। পথের সৌন্দর্য মাতাল করার মতো। এবার পৌঁছালাম এমু পাখির প্রজনন কেন্দ্র। কয়েকটি এমু পাখি জলদি জলদি দেখেই চলে এলাম লাভার্স পয়েন্টে। নামের সঙ্গেই জায়গাটির সৌন্দর্য অনুমান করে নিতে পারেন। তিরতিরে নদী ডাডুওয়ারা, পাহাড়ি উৎরাইয়ে নাচতে নাচতে নেমে আসছে পাহাড়ি মেয়ের মতো। ধূসর জলে সাদা ফেনা তুলে পাক খেয়ে চলেছে নদী, ইচ্ছেমতো পা ডুবিয়ে বসে থাকুন। কিছুটা ঘুরে ফিরে এলাম দারিংবাড়ি বাজার। 

পাইন বন, দারিংবাড়ি
 

দুপুরের খাওয়া সেরে চললাম মৃদুমন্দ ফলস দেখতে। নামটিই বলে দিচ্ছে ঝর্ণাটির মাধুর্য। এক দেখায় ভালো লাগবে, লাল মাটির পথ আর কয়েকটি সিড়ি বেয়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম মৃদুমন্দ ঝর্ণার কাছে। বর্ষাকাল বাদে এই ঝর্ণা নামের সঙ্গে তাল মিলিয়েই ঝরে পড়ে। কিন্তু বর্ষাকালে এর দাপট খুব, তখন আর মৃদুমন্দ থাকেনা এর তেজ। এই ঝর্ণা দেখে আরও একটু উপরে উঠে পাওয়া গেল ছোট্ট পাইন বন।হ্যাঁ, ঠিকই  শুনছেন, ওড়িশায় পাইন বন! এরপরই কফি বাগান। রোবস্টা, অ্যরোবিকা এই দু ধরণের কফি হয় এখানে। তিনটি কফি বাগান আছে এই তল্লাটে। একটি বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে কফি চাষ সম্মন্ধে অনেক কিছু জানলাম। তিনি আরও জানালেন যে প্রচুর সাপ রয়েছে এই বাগানে। কফি গাছ রোদ সহ্য করতে পারেনা তাই বড়ো গাছ লাগিয়ে আগে ছায়া তৈরি করে নিতে হয়। সেই বড়ো গাছে বেয়ে উঠেছে গোলমরিচ লতা। বাগানের লতানে গাছে ফলে আছে অসংখ্য গোলমরিচ। কফি ও গোলমরিচ বাগান দেখে পড়ন্ত বিকেলে চলে এলাম সানসেট পয়েন্টে। সানসেট পয়েন্টের সন্ধ্যেটা অসাধারণ। সমুদ্রের ঢেউ যেন নীল পাথর হয়ে দূরে দূরে ছড়িয়ে রয়েছে। সাঁঝের বলাকারা পথ চিনে ফিরে চলেছে আপন ঘরে। আমরাও ফিরলাম হোটেলে। 

মৃদুমন্দ ফলস

প্রয়োজনীয় তথ্যঃ হাওড়া থেকে সরাসরি চেন্নাই বা বিশাখাপত্তনমগামী ট্রেনে চেপে নামতে হবে ব্রহ্মপুর। সেখান থেকে গাড়িতে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা দারিংবাড়ি। হোটেল এবং রিসর্ট আগে থেকে বুক করে রাখলেই ভালো। গাড়িও যদি তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুক করে রাখেন তবে চিন্তা কমে যায়। প্রচুর হোটেল, রিসর্ট রয়েছে। একটা দিন মন্দাসুরুতেও থাকতে পারেন। এখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে। তবে মাথায় রাখা ভাল, বিশেষ একটি-দু’টি ছাড়া ফোনের নেটওয়ার্কের বালাই নেই।

 


Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post