২০০৮ সালের ডিসেম্বরে এক শীতের রাতে দমদম বিমানবন্দরের বাইরে তখন তিল ধরানোর জায়গা নেই। কারণ কলকাতায় পা রাখবেন ফুটবলের ভগবান। আর তাঁকে একবার স্বচক্ষে দেখতে তখন ভিড় জমিয়েছেন আট থেকে আশির ফুটবল ভক্ত। বহু টালবাহানার পর অবশেষে সেই রবিবার রাতে বৃষ্টিভেজা কলকাতায় সস্ত্রীক পা দিয়েছিলেন ফুটবল কিংবদন্তি দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। আর সেই সঙ্গে 'সিটি অফ জয়' কলকাতাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আনন্দের জোয়ারে। এই প্রতিবেদকও সেদিন ছিল বিমানবন্দরে, মারাদোনার কলকাতায় আগমণ কভার করতে।
অত রাতেও দমদম বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ভিআইপি রোড, ইএম বাইপাস হয়ে পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত রাস্তার দুধারে ছিল অসংখ্য অনুরাগী। কারোর হাতে আর্জেন্টিনার পতাকা তো কারোর হাতে ভারতের জাতীয় পতাকা। ভিআইপি রোডের কৈখালিতে তৈরি হয়েছে বিশাল এক মঞ্চ, ঠিক ছিল সংবর্ধনা দেওয়া হবে মারাদোনাকে। কিন্তু ভিড়ের জন্য সেই উদ্যোগ মাঠে মারা গিয়েছিল। কয়েক মিনিটের জন্য মারাদোনার জন্য আনা বিশেষ বাসটি সেখানে দাঁড়ালেও সেই বাস থেকে নামেনি মারাদোনা। এরপর ভিআইপি রোড ধরে তাঁর কনভয় যত এগিয়েছে ততই অবাক হয়েছেন ফুটবলের কিংবদন্তি। বারবার তাঁকে ভিআইপি রোডের ধারে অপেক্ষারত জনতার দিকে হাত নাড়াতে দেখা যায়। আবার কখনও স্ত্রী ক্লাদিয়াকে দেখিয়েছেন তাঁকে ঘিরে কলকাতার ফুটবল অনুরাগীদের উন্মাদনা।
এরপর লেকটাউন, হাডকো মোড় কার্যত জনসমুদ্রের মধ্যে দিয়ে মারাদোনার বিশেষ বাস ইএম বাইপাসে ওঠে। সেখানেও স্থানে স্থানে মারাদোনার ভক্তদের উন্মাদনায় থমকে গিয়েছিল কনভয়। একটা মানুষকে ঘিরে যে এতটা পাগল হতে পারে হাজার হাজার মানুষ সেটা সেদিন কনভয়ে উপস্থিত না থাকলে জানা যেতনা। কিন্তু সেটা ছিল ট্রেলার।
মারাদোনার কলকাতার কর্মসূচিতে সেবার ছিলনা জ্যোতি বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। কিন্তু মারাদোনার কানে গিয়েছিল বাম আন্দোলনের এই বর্ষীয়ান নেতার কথা। কলকাতায় এসে তাই প্রবাদপ্রতিম বাম নেতা জ্যোতি বসুর কথা শুনেই আবদার করে বসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার। মারাদোনার সেই কলকাতা সফরের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আরেক বাম নেতা প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী। তিনিই ব্যবস্থা করেন দুই কিংবদন্তির সাক্ষাৎকারের। সেই সফরের অন্যতম উদ্যোক্তা বাম নেতা শমীক লাহিড়ি জানিয়েছেন, ব্যস্ত সফরসূচির মধ্যেই মাত্র ১০ মিনিট সময় বের করা হয়েছিল সেবার।
কিন্তু মারাদোনা জ্যোতি বসুর সঙ্গে প্রায় ১ ঘন্টা সময় কাটিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদকও পেশাগত তাগিদে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে সল্টলেক ইন্দিরা ভবনে জ্যোতি বসুর বাড়ির সামনে অপেক্ষারত ছিল। বাইরে তখন জনসমুদ্র। কয়েক হাজার মানুষ তখন ভিড় জমিয়ে ফেলেছেন ইন্দিরা ভবনের সামনে। সেখানে তৈরি হয়েছে একটি ছোট্ট মঞ্চ। কিন্তু মারাদোনার কনভয়কে পুলিশ পিছনের দরজা দিয়ে ইন্দিরা ভবনে প্রবেশ করিয়ে দেয়।
সল্টলেকে জ্যোতি বসুর মুখোমুখি হয়ে অনুবাদকের সাহায্যে মারাদোনা তাঁকে বলেছিলেন, 'আমি ফিদেল কাস্ত্রোকে খুবই শ্রদ্ধা করি৷ আর আপনি তাঁকে খুব কাছ দেখেছেন৷ আপনাকেও আমি খুব কাছের মানুষ বলেই মনে করি৷ আর ভিতরেই প্রায় ঘন্টা খানেক কাটানোর পর মারাদোনার কনভয় পিছনের দরজা দিয়েই চলে যায়। অপেক্ষার বাঁধ ভাঙতেই শুরু হয় বিক্ষোভ। উত্তাল জনতাকে সামাল দিতে লাঠি চালায় পুলিশ। এমনকি সাংবাদিকরাও পুলিশের লাঠির হাত থেকে রক্ষা পায়নি সেদিন। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছিলেন।
যুবভারতী স্টেডিয়ামে মারাদোনাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। শুধুমাত্র একটি মানুষকে চোখের দেখা দেখার জন্য প্রায় লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল যুবভারতীতে। তিনি কয়েকটি বল হাতে নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বাঁ পায়ের একেকটি কিকে সেগুলি গ্যালারিতে পাঠিয়েছিলেন। আর তাতেই উদ্বেল হয়ে উঠেছিল কলকাতার ফুটবল অনুরাগীরা। সেই দৃশ্য দেখে সেদিন আবেগে ভেসেছিলেন ফুটবলের কিংবদন্তি।
পরে একটি ফেসবুক পোস্টে সেই কথাই উঠে আসে। তিনি লিখেছিলেন, ‘কলকাতার ফ্যানেরা অসাধারণ৷ এখানে আগেও এসেছি৷ অনেক স্মৃতি রয়েছে৷ এটা আমার কাছে বিশেষ সফর৷ এই শহর, দেশ ফুটবল পাগল৷ এখানে নতুন প্রজন্মের ফুটবল ভক্তদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি মুখিয়ে’৷ কলকাতায় থাকাকালীন কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপকে অগ্রাহ্য করে সমর্থকদের ভালবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।
আজ থেকে তিন বছর আগে দ্বিতীয়বারের জন্য কলকাতার মাটিতে পা রেখেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। সেবার মোহনবাগান মাঠে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তাঁকে পাশে পেয়েছেন ক্রিকেটের মহারাজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মারাদোনার মৃত্যুতে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে টুইট করেন। ওই টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘আমার হিরো আর নেই। আমার ম্যাড জিনিয়াস শান্তিতে ঘুমাও। আমি তোমার জন্যই ফুটবল দেখতাম’।
Post a Comment
Thank You for your important feedback