একদিনে হরিপাল, ঐতিহ্য এবং বাংলার রাবড়ি

এই বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু লুকোনো ঐতিহ্য। কলকাতা থেকে একদিনেই ঘুরে আসা যায় এরকম কয়েকটি জায়গার কথা অনেকেই জানেন না। আসুন জেনে নেওয়া যাক এরকমই একটি স্থানের গল্প। শহরের ইট-কাঠ-কংক্রিটের জঙ্গল ছাড়িয়ে গ্রাম বাংলায় বুক ভরা নিঃশ্বাস নিতে যেতেই পারেন হুগলির হরিপালে। একদিকে বাংলার ঐতিহ্য টেরাকোটার মন্দির, অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি, স্থানীয় সুস্বাদু খাবার, সবমিলিয়ে জমজমাট হতে পারে ঝটিকা সফর। কলকাতার কাছাকাছি একদিনের জন্য ঘুরতে যাওয়ার জন্য আদর্শ জায়গা হরিপাল। তবে শীতের রোদ গায়ে মেখেই হরিপাল ঘোরা ভালো। এই সময় পরিবেশ ও পরিস্থিতি দুটোই সুন্দর থাকে। 

ছ’টি গ্রাম নিয়ে এই হরিপাল, সেগুলি হল- হরিপাল, দেওয়ারহাট্টা, রাজবলহাট, আঁটপুর, ফুরফুরা সরিফ এবং আঁইয়া। ব্রিটিশ শাসনে এই হরিপাল ছিল বস্ত্রশিল্পের অন্যতম উৎকর্ষ কেন্দ্র। ইতিহাসের পাতাতেও এই হরিপালের নাম রয়েছে। ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ নামে এক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায় এখানকার রাজা কুলপালের দুই পুত্র ছিল। একজন হরিপাল এবং অন্যজন অহিপাল। পরবর্তী সময় এই হরিপাল হুগলির সিঙ্গুরের পশ্চিম অংশে একটি মহাগ্রাম স্থাপন করেন। এখানে বসতের জন্য দীঘি-সরোবর খনন করান তিনি, স্থাপন করেন হাটবাজার। এবং এই মহাগ্রামের নাম নিজের নামেই রাখেন ‘হরিপাল’। একটি মতে এই এলাকার প্রাচীন নাম ছিল ‘সিমুল’। রাজা হরিপাল সম্ভবত বঙ্গের বিখ্যাত পাল বংশেরই সন্তান ছিলেন। 

এবার ইতিহাস থেকে ভুগোলে আসা যাক। বর্তমানে হরিপাল অঞ্চলে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির। এরমধ্যে অন্যতম রাইপাড়ার রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দির। মন্দিরটি আঁটপুর গ্রামে অবস্থিত। মূল মন্দিরের দক্ষিণ অংশে রয়েছে একটি দোলমঞ্চ এবং তিনটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলি আটচালা আদলে তৈরি অসাধারণ কারুকার্যমণ্ডিত। প্রতিটি মন্দিরের সামনের দেওয়াল টেরাকেটার অপরূপ কারুকার্যে শোভিত। যদিও কয়েক জায়গায় ওই টেরাকোটা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে সঠিক যত্নের অভাবে। তবে মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে ও ছাদ জুড়ে আছে একশো আটটি পদ্মের ব্লক যার প্রতিটি ফুলের গঠন আলাদা। চণ্ডীমণ্ডপ এবং দোলমঞ্চে রয়েছে কাঠ ও পোড়ামাটির অসাধারণ কারুকাজ। দোলমঞ্চটিও আটচালা আদলে তৈরি এবং চারটি পিলারের ওপর স্থাপিত। প্রতিটি পিলার সুন্দর কারুকাজের আর্চ দিয়ে যুক্ত। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটায় খোদাই করা হয়েছে ১৮টি পুরাণের বিভিন্ন গল্পের দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। ইতিহাস বলছে, এই ১০০ ফুট উঁচু রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন বর্ধমানের রাজার দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র। তৈরি হয়েছিল ১৭৮৬ সালে। এই মন্দিরের পাশেই রয়েছে ইট বাঁধানো একটি সরোবর। এবং রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দির চত্বরেই রয়েছে গঙ্গাধারা, জলেশ্বর, বানেশ্বর ও রামেশ্বর মন্দির। 

আঁটপুরের মিত্র বাড়ির পাশেই রয়েছে ঘোষ বাড়ি। এখানেই রয়েছে আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশন। জানা যায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য প্রেমানন্দ মহারাজের বসত ভিটে। সন্নাস গ্রহনের আগে তিনি এই পরিবারের সদস্য ছিলেন। এই বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং শ্রীশ্রী সারদা মা। ১৮৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই বাড়িতেই বৈঠকের পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের নয়জন শিষ্য একসাথে সংসার ধর্ম ত্যাগ করেই সন্নাস গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরমধ্যে স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন। এখানে একটি ঠাকুর রামকৃষ্ণের মন্দির রয়েছে এবং তাঁর নয় শিষ্যের সন্নাস গ্রহনের স্মৃতি বিজড়িত ধুনি মণ্ডপ রয়েছে। 

আঁটপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে রাজবলহাট গ্রাম। এই গ্রামটির সুনাম কার্যত দুটি কারণে। একটি হল রাজবল্লভী মাতার মন্দির। অন্যটি হল এখানকার বিখ্যাত তাঁতের শাড়ি। রাজবল্লভী মাতার নাম অনুসারেই এই গ্রামের নাম রাজবলহাট। এই মন্দিরটি বেশ পুরোনো, আর ছুটি ও পুজোর দিনগুলিতে বেশ ভিড় হয়। ইতিহাস বলে মন্দিরটি প্রায় ৮০০ বছরের পুরোনো। এটি তৈরি করেছিলেন রাজা সদানন্দ রায়। এখানে দেবী দ্বিভূজা ও শ্বেতবর্ণা। স্থানীয় মতে এটি শ্বেত কালী, যিনি আসলে দুর্গা-কালি-সরস্বতীর মিশ্র রূপ। এছাড়া দেখে নিতে পারেন ‘শ্যামের পাট’, এখানে মদনমোহন বিগ্রহের পাশাপাশি সযত্নে রক্ষিত আছে শ্রীচৈতণ্যদেবের পদচিহ্ন। কিছুটা পায়ে হেঁটে গিয়ে দেখে নিতে পারেন ১৭৩৩ সালে নির্মিত রাধাকান্ত মন্দির। 

ফুরফুরা সরীফ-

হুগলি জেলার অতি প্রসিদ্ধ মুসলিম তীর্থক্ষেত্র হল ফুরফুরা শরিফ। ১৩৭৫ সালে মুকলিশ খান নির্মিত মসজিদ ঘিরেই প্রতিবছর মেলা বসে এখানে। ১৪ শতকে মুসলমানদের বংশধর যারা বাংলায় আক্রমণ করেছিলেন। বাগদী রাজা তখন এই অঞ্চলের শাসক এবং তিনি হজরত শাহ কবির হালিবি এবং হজরত করমুদ্দিনের কাছে পরাজিত হন। যদিও উভয়ই যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ই আজও এখানে তাঁদের সমাধিসৌধে যান। ফুরফুরা শরীফের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হজরত আবু বকর সিদ্দিক ও তাঁর পাঁচ পুত্রের মাজার শরিফ (সমাধি), যা 'পাঁচ হুজুর কেবলা' নামে খ্যাত। ফুরফুরা সরীফ ঘুরতে গেলে আপনাকে এখানকার কয়েকটি স্থানীয় মিস্টি খেতেই হবে। পাপড়ি (মূলত শোন পাপড়ি), মাসকেট (বিশেষ হালুয়া) এবং মনসুরি। 

আঁইয়া (রাবড়ি গ্রাম)

হুগলির চণ্ডীতলা ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম আঁইয়া। কিন্তু এই নামে তাঁকে কেউ চেনে না। কিন্তু যদি বলা যায় রাবড়ি গ্রাম, তবে অনেকেই এক ডাকে চিনে নেবেন। ভোর থেকেই গ্রামের প্রতিটি ঘরে জ্বলে ওঠে কাঠের চুলা। বিশাল বিশাল কড়ায় দুধ ফোটানোর কাজ চলে দিনভর। রাতেও এর বিরাম নেই। দুধ ফুটে ফুটে কখন ঘন হলে হাতপাখার বাতাস করা হয়। হাওয়া পেয়েই ঘন দুধে মোটা সর পড়তে থাকে। সেই সর কেটে কড়ার গায়ে লেপ্টে দেওয়া হয়। এ ভাবে চলতে থাকে সর তোলা। সর পুরু হলে তা পাত্রে তুলে জমিয়ে রাখা হয়। আঁইয়ার ঘরে ঘরে এটাই রোজনামচা। আপনিও চেখে দেখতে পারেন, এমনকি কিনে বাড়িও ফিরতে পারেন। ঘুরে দেখুন গ্রাম বাংলার প্রাচীন এই মিষ্টি তৈরির প্রক্রিয়া। 


কীভাবে যাবেন?

হাওড়া থেকে তারকেশ্বরগামী লোকাল ট্রেন ধরে হরিপাল চলে আসা যায়। এরপর টোটো বা অটো ভাড়া করে দিনভর ঘুরে দেখুন হরিপালের সমস্ত দর্শনীয় স্থান। এছাড়া গাড়ি ভাড়া করেও ঘুরে আসতে পারেন হরিপাল। দুপুরের খাবার খেতে পারেন রামকৃষ্ণ মিশনে। 


Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post