মিশন নবান্নঃ বাজেটে মমতাময়ী মমতা, কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে?

শিয়রে বিধানসভা ভোট। তার আগে রাজ্য বাজেট পেশ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র অসুস্থ, তাই তাঁর পরিবর্তে নজিরবিহীনভাবে মুখ্যমন্ত্রীই বাজেট পড়ে শোনালেন। প্রত্যাশামতোই এবারের অন্তর্বর্তীকালীন রাজ্য বাজেট বা ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ হল জনমুখী এবং কল্যাণকর। প্রত্যাশামতোই বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্পে বাড়ল বিপুল বরাদ্দ। তবে প্রশ্ন উঠছে, এমনিতেই বিপুল ঋণের বোঝা রাজ্যের ঘাড়ে। এই টাকা আসবে কোথা থেকে? কারণ ‘ভোট অন অ্যাকাউন্টে’ রাজস্ব বাড়ানো বা কমানোর উপায় নেই। ফলে রাজস্ব কোথা থেকে আসবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবুও প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেড়েছে বরাদ্দ। যদিও এদিন তিনি বলেছেন রাজ্যের রাজস্ব আদায় গত অর্থবর্ষে ২.৯ গুণ বেড়েছে। এদিন কার্যত বিরোধীশূন্য বিধানসভায় বাজেট পেশ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ আগেই বাজেট অধিবেশন বয়কট করেছিল বাম-কংগ্রেস। শুক্রবার বাজেট পেশের আগেই সভায় চরম হইচই শুরু করেন বিজেপি বিধায়করা। এরপর বিজেপি ওয়াকআউট করে। 

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূল নেত্রীর বরাবরের শক্তি মহিলারা। এছাড়া সংখ্যালঘু, তফসিলি জনজাতির মানুষ, সংখ্যালঘু এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষজন। এবারের বাজেটে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের জন্যই দরাজহস্ত হলেন। বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখেই তিনি মহিলাদের জন্য নতুন প্রকল্প ঘোষণা করলেন। মাতৃবন্দনা নামে নতুন প্রকল্পের সূচনা করলেন বাজেটে। আগামী অর্থবর্ষে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যায় বরাদ্দের প্রস্তাবও দিলেন। অপরদিকে অংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্যও বড় ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। করোনার লকডাউনের জেরে এই ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। এদিনের বাজেটে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, রাজ্যের ৪৫ হাজার শ্রমিককে ১০০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। তফসিলি জনজাতি, অনুন্নত সম্প্রদায় এবং অবাংলাভাষীদের জন্যও বড় ঘোষণা করলেন তিনি। 

এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, নেপালি, হিন্দ, উর্দু, কামতাপুরী জন্য ১০০টি নতুন স্কুল হবে। বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা। তফশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য ২০ লাখ ঘর নির্মাণ করা হবে। আগামী ৫ বছরের জন্য আরও নতুন বাড়ি নির্মান হবে। এর জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি রাজবংশীদের জন্য ২০০টি স্কুল খোলা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সংখ্যালঘু ভোটের দিকে তাকিয়ে মাদ্রাসাগুলির জন্যও বিপুল অর্থ বরাদ্দ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এদিন জানান, মাদ্রাসাগুলির জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হল। তফশিলি জাতি, উপজাতি ও আদিবাসীদের জন্য ১০০টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল তৈরি করা হবে। এর জন্য ৫০ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ করা হয়েছে। আদিবাসীদের অলচিকি ভাষার জন্য ১৫০০ স্কুল তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এরজন্য ব্যায় বরাদ্দ করেছেন ৫০ কোটি টাকা। 

অন্যদিকে রাজ্যের যুব প্রজন্মকেও কাছে টানতে বেশ কয়েকটি ঘোষণা ও প্রকল্প চালু করলেন এই বাজেটে। যুবশক্তি নামে বিশেষ প্রকল্প। এই প্রকল্পে সরকারি বিভিন্ন দফতরে ইনটার্ন হিবেস কাজ করার সুযোগ মিলবে। এছাড়াও UPSC-র ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য চমকপ্রদ ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। এবার থেকে বিনামূল্যে আবাসিক হিসেবে থেকে পড়াশোনা করা যাবে। এমনকী তাঁদের অনুদানও দেওয়া হবে। 

বিগত কয়েকমাস ধরে রাজ্যের পার্শ্বশিক্ষকরা নিজেদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন ও বিক্ষোভ করছেন। যা নিয়ে বেশ কয়েকবার ধুন্ধুমার বেঁধে গিয়েছিল কলকাতা ও সল্টলেকে। উল্লেখ্য, শুক্রবারও কলকাতায় পার্শ্বশিক্ষকদের নবান্ন অভিযান ঘিরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার। এদিনের বাজেট ভাষণে পার্শ্বশিক্ষকদের জন্যও বেতনবৃদ্ধি নিয়ে ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এদিন বলেন, পার্শ্বশিক্ষকদের পারিশ্রমিক আরও বাড়ানো হবে। ৩ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি করা হবে পার্শ্বশিক্ষকদের। এছাড়া অবসরের পর পার্শ্বশিক্ষকরা এককালীন ৩ লাখ টাকা করে পাবেন বলেও জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও শিক্ষক পার্শ্বশিক্ষক ঐক্যমুক্ত মঞ্চের তরফে এই ঘোষণাকে ধিক্কার জানানো হয়। তাঁদের দাবি, এই ঘোষণা তাঁরা মেনে নেবেন না, তাঁদের আন্দোলন চলবে। যদিও এদিন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, প্রস্তাবিত স্কুলগুলিতে আরও ১,৫০০ পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হবে।  

লোকসভা ভোটে তাঁর দল বিপর্যস্ত উত্তরবঙ্গে। এদিন উত্তরবঙ্গের জন্যও দরাজহস্ত মুখ্যমন্ত্রী। এদিনের বাজেট ভাষণে উত্তরবঙ্গের চা বাগানের জন্যও ঘোষণা করে তিনি। চা বাগান এলাকায় ১০০টি নতুন স্কুল খোলা হবে। ৩০০ জন পার্শ্বশিক্ষক থাকবে স্কুলগুলিতে। অপরদিকে কৃষক আন্দোলনের কথা মাথায় রেখে রাজ্যের কৃষকদের জন্য বড় ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। কৃষকবন্ধু প্রকল্পে একর পিছু অনুদান ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬ হাজার টাকা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ঘোষণার পাশাপাশি তিনি জানালেন, ‘কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সুবিধা পাবেন ভাগচাষিরাও’। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কেন্দ্রের কিষাণ সম্মান নিধি প্রকল্পের সঙ্গে রাজ্যের কৃষকবন্ধু প্রকল্পের লড়াই অব্যাহত থাকল। ভোটের আগে এটা শাসকদলের কাছে প্রচারের হাতিয়ার হতে চলেছে। 

এছাড়া, পাকা বাড়ি তৈরির জন্য দেড় হাজার কোটি বরাদ্দ করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়া ৬০ বছরের ঊর্ধ্বদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার জন্য ১ হাজার কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, বিনামূল্যে রেশনব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে চলবে। জুন, ২০২১-র পরেও চালু থাকবে বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড প্রতি ৩ বছরে নবীকরণ করা যাবে। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ। 


Post a Comment

Thank You for your important feedback

Previous Post Next Post